এইদিন ওয়েবডেস্ক,২৭ আগস্ট : পাকিস্থানের জন্মলগ্ন থেকেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে । দেশভাগের পর অসংখ্য হিন্দু,শিখকে মৌলবাদীদের হাতে খুন হতে হয়েছে । অগনিত সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ বা গনধর্ষণের শিকার হয়েছেন । আতঙ্কে তখন হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে এসেছিলেন ভারতে । এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে । এমনকি ১৩ বার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার বিজেতা ঝর্ণা বসাক ওরফে শবনমও (Jharna Basak alias Shabnam) মৌলবাদীদের লালসার হাত থেকে রেহাই পাননি । আর ৪৪ বছর আগে উপমহাদেশের শতাব্দীর সবচেয়ে সেই ঘৃণ্য গনধর্ষনের ঘটনাটি ঘটেছিল পাকিস্থানেই । স্বামী ও ছেলেকে বেঁধে রেখে তাঁদের সামনেই অভিনেত্রীকে রাতভর গনধর্ষণ করেছিল ৭ জন নরপশুর দল ।
এই পাশবিক ঘটনায় অভিযুক্তরা হল মোহাম্মদ ফারুক বন্দিয়াল (Mohammad Farooq Bandial), ওয়াসিম ইয়াকুব বাট (Wasim Yaqoob Butt), জামিল আহমদ (Jamil Ahmad),তাহির তানভীর (Tahir Tanvir), জামশেদ আকবর সাহি (Jamshed Akbar Sahi),আগা আকিল আহমদ (Agha Aqueel Ahmad) এবং মোহাম্মদ মোজাফফর (Mohammad Muzaffar) । প্রভাবশালী পরিবার থেকে আসা অভিযুক্তদের পরে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হয় । তবে অপরাধীরা গণধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত না করার জন্য স্থানীয় পুলিশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় ।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রথমে ৪১২ পিপিসি ধারার মামলা রজু করে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হয়েছিল । পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয় । আগা আকিল আহমদকে দশ বছরের কারাদণ্ড এবং মোহাম্মদ মুজাফফরকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয় । অভিনেত্রীর আইনজীবীও তাঁর সঙ্গে বেইমানি করে । সেই সঙ্গে আসামিদের ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য শবনম ও তার পরিবারের উপর ক্রমাগত চাপ আসতে থাকে । শেষে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া-উল-হক ৫ অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড রদ করে দেয় । আর তার হস্তক্ষেপে গনধর্ষণের অভিযোগ বাদ দিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে পাতি ডাকাতির মামলা রজু করে বিচার প্রক্রিয়াকে কার্যত প্রহশনে পরিনত করা হয় ।
১৯৪২ সালের ১৭ ই আগস্ট জন্ম ঝর্ণা বসাকের । তাঁকে পাকিস্তানি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আনেন কিংবদন্তি অভিনেতা ওয়াহেদ মুরাদ (Waheed Murad) । পর্দায় নিজের নাম শবনম রাখেন ঝর্ণা বসাক । ১৯৬৮ সালে ‘সমুদ্র’ চলচ্চিত্র দিয়ে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন ৷ ১৯৯৭ সালে পাকিস্তান ছাড়ার আগ পর্যন্ত মোট ১৬০ টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন । মোট ১৩ বার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান । শবনমের সঙ্গে নদিম ও রহমানের জুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় । অভিনয় জগতে সাফল্য পাওয়ার পর শবনম ভালোবেসে বিয়ে করেন বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক রবীন ঘোষকে । লাহোরের গুলবার্গে থাকতেন তাঁরা । কিন্তু ১৯৭৮ সালে ১৩ মার্চ রাতের সেই বীভৎস ঘটনা প্রতিভাবান এই শিল্পির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে ছারখার করে দেয় । আসুন জেনে নেওয়া যাক পাকিস্থানের ওই ৭ নরাধম একটা সুন্দর পরিবারকে কিভাবে ছতিছন্ন করে দিয়েছিল । পাকিস্তানি মৌলবাদীরা কিভাবে শেষ করে দিয়েছিল নিজের দেশেরই এক প্রতিভাবান অভিনেত্রীর জীবন, কেন তিনি বাধ্য হয়েছিলেন দেশত্যাগ করতে ।
সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জানা যায়,১৩ মার্চ গভীর রাতে সদ্য শ্যুটিং সেরে বাড়ি ফিরেছেন ঝর্ণা বসাক । একটু ফ্রেস হয়ে স্বামী রবীনের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে খেতে গল্প করছেন তিনি । ঘরে শুয়ে ঘুমচ্ছিল তাঁদের নাবালক ছেলে রনি । সেই সময় মানবজাতির কলঙ্ক ওই ৭ দুষ্কৃতী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে ঝর্ণা বসাকের বাড়িতে । কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই রবীনবাবুকে তারা পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে । এদিকে চিৎকারে কিশোর রনির ঘুম ভেঙে যায় । তাকেও বেঁধে ফেলে ওই দুষ্কৃতীরা । তারপর স্বামী ও সন্তানের সামনেই ওই নরকের কীটের দল ঝর্ণাদেবীকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করতে শুরু করে । রাতভর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে ভোরের দিকে তারা পালিয়ে যায় ।
এই ঘটনার পর অভিনয় তো দূরের কথা কার্যত অর্ধমৃত অবস্থা হয়ে যায় ঝর্ণা বসাকের । বাক রুদ্ধ হয়ে যান তাঁর স্বামী ও সন্তান । তারই মধ্যে তাঁরা ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন । কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বাধীন সরকারের চাপ ও নিজের আইনজীবী এসএম জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ন্যায় বিচারের আশা ত্যাগ করেন ঝর্ণা বসাক । শেষ পর্যন্ত তিনি সপরিবারে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন । প্রথমে বাসস্থান হিসাবে লন্ডনকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি । পরে ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে পাকাপাকি ভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন ।
এদিকে মূল আসামি ফারুক বান্ডিয়াল পরবর্তী সময়ে পাকিস্থানের পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তার বন্ধুরা সবাই ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় । ২০১৮ সালে ফারুক বনদিয়াল ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পিটিআই তে যোগদান করে । কিন্তু মিডিয়ায় ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের কারনে ইমরান খান তাকে পিটিআই থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় ।’।