প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৭ সেপ্টেম্বর : সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে চোখে আঘাত লোগেছিল।তার পর থেকে নাবালিকা রিয়া মাঝির দুটো চোখই যেন ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসছে । বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রেসক্রিপশনে রিয়ার চোখের এই জটিল অবস্থাকে ডাক্তরি পরিভাষায় ’প্রোপটোসিস’ (Proptosis) বলে উল্লেখ করা হয়েছে । সুচিকিৎসার জন্য বর্ধমান হাসপাতালের চিকিৎসক রিয়াকে কলকাতা মেডিকেল কলেজের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি(আর আই ও )বিভাগে রেফার করেছেন।এমনকি যত দ্রুত সম্ভব রিয়াকে সেখানে ভর্তি করার কথাও তাঁর বাবা মাকে জানিয়েছেন বর্ধমান হাসপাতালের চিকিৎসক। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় যাওয়া আসা করার মত আর্থিক সামর্থ টুকুও নেই এই কন্যার দিনমজুর বাবা মায়ের ।এই অবস্থায় মেয়ের চোখের চিকিৎসা করানোর জন্য দরিদ্র বাবা মা নানা জনের পায়েধরে অর্থ ভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছেন ।
বর্ধমান হাসপাতালের চক্ষু চিকিৎসা বিভাগের প্রধান ডাঃ মৌসুমি বন্দ্যোপাধ্যায় জানান,মূলত ’থাইরয়েডের’ কারণেই নাবালিকার চোখের এমন জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। মেয়েটির বাম চোখটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। অন্য চোখটা বাঁচাতে হবে।সেই কারণেই মেয়েটিকে কলকাতায় ’রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি বিভাগে’রেফার করা হয়েছে
। ওখানে চোখের চিকিৎসার অনেক উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। মেয়েটিকে ওখানে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গেলে ভালই হবে বলে মৌসুমি বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন।
রায়না থানার প্রত্যন্ত গ্রাম বোরো বালাগড় ।
সেখানেই রিয়াদের আদি বাড়ি।রুটি রুজি
জোগাড়ের জন্য বেশ কয়েক বছর হল তাঁর বাবা অলক মাঝি ও মা ঝুমা মাঝি জামালপুর থানার বেরুগ্রাম অঞ্চলের সালিমডাঙ্গা গ্রামে থাকছেন। সেখানে ফাঁকা মাঠের এক প্রান্তে ছিটে বেড়ার এক কুটুরি ঘরে বছর ১২ বয়সী নাবালিকা রিয়াকে নিয়ে বসবাস করেন মাঝি দম্পতি ।দারিদ্রতা তাঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী।প্রতিদিন দু’মুঠো ভাত যোগাড় করাটাই এই পরিবারের কাছে বড় দুঃসাধ্যের।ঝুমা মাঝি জানিয়েছেন ,’তাঁরা যখন বোরো বালাগড়ে থাকতেন তখন তাদের মেয়ে রিয়া সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তো।তখন তার চোখের কোন সমস্যা ছিল না। সালিমডাঙ্গা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করার পর বছর দুই আগে হওয়া দুর্ঘটনার পর থেকে তাঁর মেয়ের চোখের এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে ।
কি ভাবে ঘটেছিল সেই দুর্ঘটনা ? এর উত্তরে ঝুমাদেবী বলেন,’তাঁরা স্বামী স্ত্রী দু’জনেই এলাকায় খেতমজুরির কাজে গিয়েছিলেন।ওই দিন আমাদের জন্য ভাত রান্না করে মেয়ে রিয়া।সেই ভাত আমাদের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য রিয়া সালিমডাঙ্গার বাড়ি থেকে সাইকেলে চড়ে রওনা হয়।পথে ব্যালেন্স হারিয়ে সাইকেল নিয়ে রিয়া রাস্তা থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ে। ওই সময়ে রিয়ার বাম চোখে সাইকেলের ব্রেক ও হ্যান্ডেলের আঘাত লাগে ’। ঝুমা মাঝি আরো জানান ,’তাঁর মেয়ের চোখের আঘাত যে এত গুরুতর তা তাঁরা তখন বুঝতে পারেন নি।সময় গড়ানোর সাথে সাথে তাঁর মেয়ের বাম চোখে যন্ত্রনা শুরু হয়।চিকিৎসার জন্য মেয়েকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তার বাবুরা চোখের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দেন । কিন্তু অর্থের অভাবে বেশি দিন সেই দামি ওষুধ কিনে খাওয়াতে পারেন নি।তার পর থেকে কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর মেয়ের বাম চোখের বিভৎস অবস্থা তৈরি হয়।চোখটা যেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছে।ইদানিং ডান চোখটারও অবস্থা একই রকম হয়ে যাচ্ছে।তাঁর মেয়ের চোখের দৃষ্টি শক্তিও কমে আসছে বলে ঝুমাদেবী জানিয়েছেন ।
নাবালিকার বাবা অলক মাঝি বলেন,যদি তাঁরা স্বামী স্ত্রী মিলে একসাথে একদিন কাজ পান তাহলে মজুরি বাবদ ৪০০ টাকা তাঁদের উপার্জন হয়। কিন্তু সব দিনতো আর তা হয় না।সারা বছরে শুধু মাত্র ধান রোয়া ও আলু চাষের সময়ে খেত মজুরের চাহিদা থাকে । বাকি সারাটা বছর লোকের কাছে কাজ চাইতে হয়। তখন কোন কোন দিন কাজ মিললেও বেশির ভাগ দিন তাঁদের বেকার হয়েই ঘরে বসে থাকতে হয় । চোখের জল মুছতে মুছতে এদিন অলক মাঝি বলেন,’আমার মেয়ের দুটো চোখের অবস্থাই খুব খারাপ হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে ফের মেয়েকে নিয়ে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে গিয়েছিলাম।মেয়ের দু’চোখের অবস্থা দেখে ডাক্তার বাবুরা জানিয়ে দিয়েছেন চোখের এই জটিল অবস্থার চিকিৎসা কলকাতা মেডিকেল কলেজের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি (আর আই ও ) বিভাগে ছাড়া সম্ভব নয়। তাই ডাক্তার বাবুরা সেখানেই রিয়াকে রেফার করেছেন ।এমনকি যত দ্রুত সম্ভব রিয়াকে কলকাতার ওই হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানোর জন্যও ডাক্তার বাবুরা পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু মেয়েকে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ,সেখানে থেকে চিকিৎসা করানো ও কোন ওষুধের প্রয়োজন হলে তা কিনে দেবার মত টাকা পয়সাও এখন তাঁদের হাতে নেই।তাই মেয়ের চোখের চিকিৎসার অর্থ জোগাড়ের জন্য তাঁরা স্বামী স্ত্রী মিলে নানা জনের কাছে গিয়ে হাত জোড় করে, পায়ে ধরে অর্থ সাহায্য চাইছেন।
জামালপুর নিবাসী শুভঙ্কর ভাণ্ডারি বলেন,’মেয়ের চোখের চিকিৎসার জন্য ওই অসহায় বাবা মা যে ভাবে নানা জনের হাতে পায়ে ধরে সাহায্যের আবেদন করছেন তা যথেষ্টই হৃদয় বিদারক।তাই ওনাদের পাশে না দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি’।শুভঙ্কর বাবুর মতোই জামালপুরের আরো অনেক বাসিন্দা বলেন,’তাঁরাও নাবালিকার বাবা মায়ের অসহায়তা চাক্ষুষ করে ব্যাথিতই হয়েছেন । সব শুনে বিডিও (জামালপুর )শুভঙ্কর মজুমদার ওই নাবালিকার পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন ।।