জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বর্ধমান,২৫ মে : ইতিহাস সাক্ষী যেকোনো সাম্রাজ্যের, সেটা রাজতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক হতে পারে, পতনের পেছনে একটা প্রত্যক্ষ বা মূল কারণ থাকলেও একাধিক অনান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকে। এই রাজ্যে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট একটানা চৌত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর ২০১১ সালে রাজত্বের অবসান ঘটে। বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি বা আলিপুর ট্রেজারি কেলেঙ্কারি থাকলেও তারা সেটা স্বীকার করেনা। জ্যোতি বসুর মন্ত্রীসভাকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চোরেদের মন্ত্রীসভা বললেও তারা সেটা মানতে চায় না। একাধিক গণহত্যার দোষীরা গ্রেপ্তার হয় না। হাওড়া, ব্যারাকপুর, দুর্গাপুর প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলে শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করলেও তাতে তাদের কোনো দায়িত্ব থাকে না। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কর্মসংস্কৃতি লাটে উঠলেও সেটা ফিরিয়ে আনার নুন্যতম চেষ্টা করা হয় না। তাহলে তাদের পতনের কারণ কি? ২০১১ ভোটে বিপর্যয়ের পর বারবার ফিরে আসার চেষ্টা করলেও তারপর থেকে শুধুই ব্যর্থতার গল্প। গত বিধানসভা ভোটে শূন্য হাতে ফেরা। একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সিপিএম নেতা তাদের পরাজয়ের কারণ নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিল না ।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতার দিকে আঙুল তুলে মেদিনীপুরের এক তৃণমূল নেতা বললেন,’তার হাত ধরে মাধ্যমিকে ফেল করা হাজার হাজার ছেলে স্কুলে চাকরি পেয়েছে ।’ খুব ভাল লাগল তিনি স্বীকার করে নিলেন যে তৃণমূলের আমলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগে দূর্নীতি হয়েছে। এবার তিনি তার কথিত ‘হাজার হাজার’ ছেলের তালিকা প্রমাণ সহ আদালতের হাতে তুলে দিন। সম্ভবত বলার সময় তার মাথায় ছিলনা, যখন নিয়োগ হয় শুভেন্দু তখন তৃণমূলে ছিলেন । সুতরাং দূর্নীতির দায় তৃণমূল সরকারের উপরে বর্তায় ।
বছর তিনেক আগে লোকসভা ভোটের সময় অর্জুন সিং তৃণমূল ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দেয়। কারণ স্পষ্ট। দলীয় বিধায়ক অর্জুনকে তৃণমূল লোকসভা ভোটে টিকিট দেয়নি। বিজেপি তাকে লোকসভার টিকিট দেয়। ভোটে জেতার পর অর্জুন বাহিনীর তাণ্ডব স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা তো বটেই বাসিন্দারাও জানে। ২০২১ এর বিধানসভা ভোটের আগে-পরে বাছা বাছা শব্দে তৃণমূল বনাম প্রাক্তন তৃণমূলী অর্জুনের পারস্পরিক আক্রমণের মধ্যে আনন্দের খোরাক ছিল। অবশেষে সেই অর্জুন আবার তৃণমূলে ফিরে এলো। ফিরে আসার পেছনে সে যে যুক্তিই পেশ করুক না কেন মোদ্দা কথা পরবর্তী লোকসভা ভোটে তার জেতার তাগিদ ছিল বেশি। বর্তমানে এই রাজ্যে বিজেপির যা পরিস্থিতি তাতে বিজেপি হয়ে লড়াই করে তার জেতা কার্যত অসম্ভব হতো ।
গত বিধানসভা ভোটের আগে একগুচ্ছ ছেঁদো যুক্তি দিয়ে সব্যসাচী, শুভেন্দু, রাজীবের মত রাজ্য জুড়ে পরিচিত মুখ এবং কিছু স্থানীয় স্তরের পরিচিত মুখ তৃণমূল ছেড়ে ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দেয়। সুনীল মণ্ডলের মত দলীয় সাংসদরা সরাসরি দল না ছাড়লেও বিজেপির মিটিং মিছিলে যোগ দেয়। যেভাবে মিডিয়া ‘হাইপ’ তুলেছিল এবং প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্য যাত্রী হয়ে উঠেছিল তাতে তাদের আশা ছিল ভোটে তৃণমূল হেরে যাবে এবং তাদের মৌরসিপাট্টা বজায় থাকবে। কিন্তু ভোটের ফলে সব গণ্ডগোল হয়ে গেলো। অতএব নির্লজ্জের মত ফিরে এলো তৃণমূলে। ফিরে আসার জন্য আরও অনেকেই আলাচালা করছে। লকেট চ্যাটার্জ্জী, অনুপম হাজরা সহ একাধিক ব্যক্তির নাম শোনা যাচ্ছে। পঞ্চায়েতের ভোট পর্যন্ত ধীরে ধীরে অনেকেই ফিরবে। এই রাজ্যে বিজেপির যা অবস্থা তাতে পঞ্চায়েত ভোটে বিপর্যয় অনিবার্য। তখন কিন্তু ফিরে আসার গতিটা বহু গুণ বেড়ে যাবে।
ফিরে তো আসবে কিন্তু অতীতের প্রভাব কি আর থাকবে? বিধাননগর পুরসভার চেয়ারম্যান হওয়ার আশা ছিল সব্যসাচীর,তবে তা মিটল না। রাজীব আজ ত্রিপুরায়। সুনীল মণ্ডল কি করছে জানা যাচ্ছে না। তৃণমূল ত্যাগী অন্যান্যরা মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।
ধান্দাবাজ রাজনীতিবিদদের আসা-যাওয়াটা মূলত ডানপন্থী দলের মধ্যে হয়। তারা ভাল করেই জানে বামপন্থী দলগুলো তাদের পাত্তা দেবেনা। ওখানে গেলেই নেতা হওয়া যাবে না। খুব কড়া অনুশাসন। কংগ্রেস অনেক দিন আগেই স্মৃতির অন্তরালে। বিজেপিও মোটামুটি ২০১৯ সালের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। থাকল তৃণমূল। বর্তমানে এই দলটা যেভাবে কর্পোরেট ধাঁচে চলছে তাতে মনে হচ্ছে যোগ দিলেই সহজে ভোটের টিকিট পাওয়া যাবে না। আবার বিজেপিতে ফিরে গেলে বিশ্বাসযোগ্যতা বলে কিছুই থাকবে না। বলা যায় খুব শীঘ্রই বহু ধান্দাবাজ রাজনীতিবিদ ফেয়ারওয়েল নিয়ে রাজনীতিতে প্রাক্তন হয়ে যাচ্ছে। তবে লাখ টাকার প্রশ্ন- কি হবে শুভেন্দুর? এবার কি সেও? দেখতে থাকুন, ডিং ডং!!