বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন(এসআইআর) নিয়ে তোলপাড় চলছে । ইতিমধ্যে তার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন । ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে অধূনা ভোটার তালিকার ম্যাপিংয়ে বিস্তর ফারাক পেয়েছে কমিশন । কোথাও কোথাও ৫০ শতাংশের অধিক ভোটার রেড জোনের মধ্যে পড়ে গেছে বলে খবর সামনে আসছে৷ এসআইআর রুখতে ব্যর্থ বঙ্গের শাসকদল এখন নির্বাচন কমিশনের উপর চাপ বৃদ্ধির কৌশল নিয়েছে ৷ কিন্তু বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সাফ জানিয়েছেন, মৃত,ডবল এন্টি ও রোহিঙ্গা-বাংলাদেশি মুসলিম ভোটারের নাম ভোটার তালিকায় থাকবে না । তার হিসাব অনুযায়ী, এক কোটির অধিক ভুয়ো ভোটারের নাম ভোটার তালিকা থেকে এসআইআর-এ বাদ যাবে । তবে আজ রবিবার তিনি কলকাতায় সাংবাদিক বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে তৃণমূল কংগ্রেস নিশ্চিত এসআইআর-এ সহযোগীতা করবে না । তবুও এসআইআর-এর কাজ ৫০ শতাংশ সঠিকভাবে হলে তৃণমূলের পরাজয় নিশ্চিত বলে মনে করছেন তিনি । যাই হোক,এটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বিষয় । কিন্তু মধ্যপ্রদেশ থেকে এমন একটা খবর সামনে আসছে যা চমকে দেওয়ার মত । যার সঙ্গে এরাজ্যের প্রত্যক্ষ যোগসূত্র রয়েছে । ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে ।
বলা হচ্ছে যে মধ্যপ্রদেশ পুলিশ বাংলাদেশি সন্দেহে পলাশ অধিকারী নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কথা বলা পলাশ নিজেকে ভারতীয় এবং হিন্দু বলে দাবি করেছে। সূর্য মিশ্র নামে একজন এক্স ব্যবহারকারী লিখেছেন : বাকি গল্পটি পড়ে আপনি চমকে যাবেন… কারন পুলিশের স্থির বিশ্বাস যে সে ভারতীয় নয়। কিন্তু পলাশ তার আধার কার্ড, ভোটার আইডি, প্যান কার্ড এবং আরও বেশ কিছু নথি দেখিয়েছে যা প্রমাণ করে যে সে একজন ভারতীয় নাগরিক এবং একজন হিন্দু। তা সত্ত্বেও, পুলিশ তাকে বিশ্বাস করেনি এবং মামলাটি আদালতে যায়। আদালতে, পলাশকে কিছু মৌলিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : নাম ? পলাশ অধিকারী । বয়স ? ৪২ বছর । বাবার নাম? রমেশ অধিকারী । ঠিকানা? কাশিমপুর, মালদা, পশ্চিমবঙ্গ । আদালত ভোটার তালিকা এবং আধার রেকর্ডের বিপরীতে এই তথ্যগুলি যাচাই করে দেখেছে যে এই সমস্ত তথ্য রেকর্ডে উপস্থিত ছিল।
মালদার বাসিন্দা রমেশ অধিকারীর চার ছেলে দেখানো হয়েছে: পলাশ, শুভ্রোত, সৌমেন এবং রাহুল। এখন প্রশ্ন উঠেছে: রমেশ অধিকারী যদি ভারতীয় হন, তাহলে তার ছেলেরাও স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় হতে হবে। কিন্তু যখন আদালত পুরাতন রেকর্ড, বিশেষ করে ২০০২ সালের বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন (SIR) পরীক্ষা করে, তখন একটি চমকপ্রদ সত্য উঠে আসে। আর সেটা হল : ২০০২ এবং ২০১০ সালের রেকর্ডে, রমেশ অধিকারীর মাত্র দুটি ছেলে ছিল: শুভ্রোত এবং সৌমেন। পলাশ এবং রাহুলের নাম উল্লেখ করা হয়নি। ২০১৫ সালে, রমেশের চার ছেলেরই হঠাৎ ভোটার তালিকায় নাম উঠে আসে।
তদন্ত এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রকাশ পায়:
রমেশের বিয়ে হয়েছিল ১৯৯৩ সালে।প্রথম ছেলে শুভ্রতোর জন্ম ১৯৯৫ সালে (বর্তমানে ৩০ বছর)। দ্বিতীয় ছেলে সৌমেনের জন্ম ১৯৯৭ সালে (বর্তমানে ২৮ বছর)। কিন্তু পলাশের বয়স ছিল ৪২ বছর—অর্থাৎ তার জন্ম ১৯৮৩ সালে, রমেশের বিয়ের আগে। কিন্তু এটা অসভব ৷ যখন রমেশ অধিকারীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি পলাশ বা রাহুলকে চেনেন? তখন তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিল যে সে চেনেন না। তারপর পলাশের আসল পরিচয় প্রকাশ পায় ।
পলাশ অধিকারী আসলে শেখ মঈনুদ্দিন, বাংলাদেশের খুলনার আহমেদপুরের বাসিন্দা। সে অনুপ্রবেশের পর পশ্চিমবঙ্গ থেকেই রমেশ অধিকারীর অজান্তে তাকে বাবা বানিয়ে জাল নথি বানায় । সেই নথি ব্যবহার করে এবং ভারতীয় ও হিন্দু পরিচয় দিয়ে বসবাস শুরু করে । গত ১০ বছর ধরে, সে শ্রমিক পরিচয় দিয়ে গোপনে মৌলবাদী কার্যকলাপে জড়িত ছিল। রাহুল অধিকারী নামের এই ব্যক্তি কে তা কেউ জানে না—পুলিশ তাকে খুঁজছে।
একজন সাধারণ কৃষক রমেশ অধিকারী নিজেই বিস্মিত হয়েছিলেন যে কীভাবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি নথিপত্রে তার সন্তান হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। এই ঘটনাটি দেখায় যে হাজার হাজার বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী কীভাবে জাল নামে আধার, ভোটার আইডি এবং প্যান কার্ড তৈরি করে নিজেকে ভারতীয় পরিচয় দিয়ে এদেশে বসবাস করছে । এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তবে কিছু সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনাটির প্রতিবেদন আকারে ছাপা হয়েছে । “মাধ্যম” নামে একটি পোর্টালের প্রতিবেদন অনুযায়ী,বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাসিন্দা শেখ মঈনুদ্দিন দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘পলাশ অধিকারী’ নামে ভারতের নাগরিক হিসেবে জীবন কাটাচ্ছিল । হিন্দু পরিচয়ে, মালদার কৃষক রমেশ অধিকারীর ছেলে পলাশ পরিচয় দিয়ে বহাল তবিয়তে মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলায় বসবাস করছিল । সম্প্রতি পলাশ গ্রেফতার হওয়ার পর সামনে আসে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য। মধ্যপ্রদেশ থেকে বাংলাদেশি সন্দেহে সম্প্রতি ধরা হয় পলাশ অধিকারীকে। কিন্তু পলাশের উচ্চারণ, স্থানীয় ভাষা ও পারিবারিক তথ্য নিয়ে কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ে পুলিশের। সব কিছু দেখে বিচারকের সন্দেহ হয়।
কীভাবে ভারতীয় নথি পেল মঈনুদ্দিন?
তদন্তে উঠে এসেছে যে, মঈনুদ্দিন ২০১২ সালে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এরপর বিহার, ঝাড়খণ্ড হয়ে পৌঁছে যায় মধ্যপ্রদেশে। এই সময়েই স্থানীয় দালালদের সহায়তায় সে জোগাড় করে, জাল পশ্চিমবঙ্গের ডোমিসাইল সার্টিফিকেট। ভোটার আইডি, যেখানে রমেশ অধিকারীর ছেলের নাম হিসেবে নিজেকে নিবন্ধন করে মঈনুদ্দিন। নাম নেয় পলাশ। আধার কার্ড, ভোটার আইডির ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় প্যান কার্ড ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট।
‘রাহুল অধিকারী’ কে?
২০১৫ সালের তালিকায় থাকা সন্দেহজনক নাম ‘রাহুল অধিকারী’ নিয়েও চলছে তদন্ত। অনুমান করা হচ্ছে, শেখ মঈনুদ্দিনের মতোই সেও আর এক বাংলাদেশি,যে একই চক্রের মাধ্যমে ভারতের বৈধ নথি পেয়েছেন। মালদার স্থানীয় কিছু সচেতন নাগরিক অভিযোগ করছেন, পঞ্চায়েত ও রাজনৈতিক নেতারা বহু বছর ধরেই এই অনুপ্রবেশ ও জাল নথিপত্র তৈরির বিষয়ে অবগত। ভোট ব্যাংক বজায় রাখতে এসব বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
গোপন গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, শেখ মঈনুদ্দিন পূর্ব ভারতে সক্রিয় কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। যদিও এখনো পর্যন্ত সরাসরি কোনো সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তদন্তকারী সংস্থা মনে করছে সে একটি রিক্রুটার ও কুরিয়ার হিসেবে কাজ করত। এই ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তির জালিয়াতির গল্প নয়, এটি একটি সিস্টেমের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি এবং একটি গভীর নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের সংকেত। প্রশাসনের দুর্বলতা, রাজনৈতিক স্বার্থ এবং সীমান্ত এলাকায় নথিপত্র জালিয়াতির সহজলভ্যতা জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে ।
বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী শেখ মঈনুদ্দিনের মালদার পলাশ অধিকারী হয়ে ওঠার ঘটনাটি ইংরাজি মিডিয়া আউটলেট অর্গানাইজ উইকলির গত ৩১ জুলাইয়ের একটি প্রতিবেদনেও প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে৷ বিভিন্ন এক্স হ্যান্ডেলে “পলাশ অধিকারী”র এই কাহিনী শেয়ার করা হয়েছে৷ ওই সমস্ত এক্স ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া হল : কেন্দ্র সরকার ভোটার তালিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা এবং এই ধরনের জাল নাগরিকদের সনাক্তকরণ এবং অপসারণের দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু ভোটব্যাংকের স্বার্থে কংগ্রেস,বামপন্থী, তৃণমূল কংগ্রেসের মত কিছু দল এস আই আর-এর বিরোধিতা করে দেশকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে ।।

