দিনটা ছিল ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারীর বিকেল ৫:১৭ মিনিটে । গান্ধী তখন নয়াদিল্লীতে । উপবাসের জাগরণ এবং প্রার্থনা সভায় অংশগ্রহণ করে ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে কথা বলছিলেন ৭৮ বর্ষীয় গান্ধী । সেখানেই নাথুরাম গোডসে তার পেট ও বুক লক্ষ্য করে পরপর তি রাউন্ড গুলি ছোড়েন । পাশেই ছিলেন গান্ধীর ব্রহ্মচর্য্যের পরীক্ষার সঙ্গিনী তার নাতনি হিসেবে, প্রায়শই তাঁকে “হাঁটার লাঠি” হিসাবে উল্লেখ করা হত তাকে । ঘটনাস্থলেই গান্ধী রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন এবং তার মৃত্যু হয় ।
কিন্তু গান্ধীকে হত্যার ওই রাতে কি ঘটেছিল তা দেশবাশীর কাছে আজও লুকিয়ে রাখা হয়েছে । এটা জানা উচিত যে গান্ধীর তথাকথিত ‘অহিংসার পূজারী’ শিষ্যরা যারা নিজেদের উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, অহিংসক বলে দাবি করত, তারা সেই রাতে গান্ধীর নামে কত বড় পাপ করেছিল । ইতিহাসের বই থেকে এই পাপ মুছে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সত্য গোপন করলেই তা বদলে দেওয়া যায় না, এই কথিত উদারপন্থীরা, এই ধর্মনিরপেক্ষরা আবারও গান্ধীবাদের মুখোশের আড়ালে তাদের নোংরা কৌশল খেলে ।
গান্ধী হত্যার পর, গভীর রাতে সারা ভারতে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে গান্ধীর হত্যাকারীর নাম নাথুরাম গডসে এবং তার জাত ছিল চিৎপবন ব্রাহ্মণ।কিছুক্ষণের মধ্যেই,গান্ধীর প্রতি বিশ্বাসী “অহিংসার পুজারীরা” মহারাষ্ট্রসহ গোটা দেশে গণহত্যা শুরু করে । ১৯৮৪ সালের মতো, এই কংগ্রেস কর্মীরা মহারাষ্ট্রের চিৎপাবন ব্রাহ্মণদের লক্ষ্য করে দাঙ্গা শুরু করেছিল। দাঙ্গা প্রথমে মুম্বাইতে শুরু হয়েছিল, সেই রাতে ১৫ জন এবং পুনেতে ৫০ জন নিহত হয়েছিল। অথচ এই নরসংহার সুকৌশলে চেপে যায় জহরলাল নেহেরু ও প্যাটেলরা । তবে ভারতের তাঁবেদার সংবাদমাধ্যম খবরটি গোপন করে গেলেও আমেরিকান সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট এই গণহত্যার শিরোনাম করেছিল ।
তবে সবচেয়ে দুঃখজনক পরিণতি হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী ডঃ নারায়ণ সাভারকরের। নারায়ণ সাভারকর ছিলেন বীর সাভারকরের ছোট ভাই। গান্ধী হত্যার একদিন পর, জনতা প্রথমে রাতে বীর সাভারকরের বাড়িতে আক্রমণ করে কিন্তু সেখানে খুব বেশি সাফল্য না পেয়ে, তার ছোট ভাই ডঃ নারায়ণ সাভারকর, যিনি শিবাজি পার্কে থাকতেন, তার উপর আক্রমণ করা হয়েছিল। নারায়ণ সাভারকরকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনা হয়েছিল এবং জনতা তাকে পাথর ছুঁড়ে মারতে থাকে যতক্ষণ না তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান… এর কয়েক মাস পরে ডঃ নারায়ণ সাভারকর মারা যান । স্বাধীনতা সংগ্রামী ডঃ নারায়ণ সাভারকরের কী অপরাধ ছিল যার জন্য তাকে পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল? এই মুক্তিযোদ্ধার কি এত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু প্রাপ্য ছিল?
প্রাথমিকভাবে, শুধুমাত্র চিৎপাবন ব্রাহ্মণদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল কিন্তু গান্ধীর “অহিংসার পুরোহিতরা” সমস্ত মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের লক্ষ্যবস্তু করতে শুরু করেছিলেন। মুম্বাই, পুনে, সাংলি, নাগপুর, নাসিক, সাতারা, কোলহাপুর, বেলগাঁও (বর্তমানে কর্ণাটকে) -এ ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। গয়া সাতারাতে মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের ১০০০টি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। একই পরিবারের তিনজন পুরুষকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল শুধুমাত্র তাদের উপাধি গডসে হওয়ার কারণে। সেই গণহত্যার সময়, যাদের নাম ছিল আপ্তে, গোখলে, জোশী, রানাডে, কুলকার্নি, দেশপাণ্ডের মতো পদবিধারী ব্যক্তিরা,অহিংসার পূজারীরা জনতা তাদের রক্তের জন্য পিপাসু হয়ে ওঠে ।
মারাঠি লেখক এবং তরুণ ভারত পত্রিকার সম্পাদক গজানন্দ ত্রিম্বক মাদখোলকরের “এক নির্বাস্তবী কাহিনী” (একজন শরণার্থীর গল্প) বই অনুসারে, গান্ধীবাদীদের এই সহিংসতায় প্রায় ৮ হাজার মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ নিহত হন। ৩১ জানুয়ারী মাদখোলকরের বাড়িতেও আক্রমণ করা হয় এবং তাকে মহারাষ্ট্রের বাইরে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে, তিনি “একা নির্বাস্তবী কাহিনী” (একজন শরণার্থীর গল্প) বইটি লিখেছিলেন ।
কিন্তু যখন আপনি ১৯৪৮ সালের এই গণহত্যার রেকর্ড খুঁজবেন, তখন আপনি সর্বত্র হতাশ হবেন। আজ পর্যন্ত ভারতে সংঘটিত সমস্ত দাঙ্গার তালিকায় আপনি ১৯৪৮ সালের ব্রাহ্মণ-বিরোধী দাঙ্গার উল্লেখ তো পাবেন, কিন্তু যখন আপনি নিহত মানুষের কলামের দিকে তাকালে “অজানা” লেখা দেখতে পাবেন ! তার মানে দাঙ্গা হয়েছিল কিন্তু কতজন ব্রাহ্মণ নিহত হয়েছিল তার কোনও উল্লেখ নেই ।
কেন এটি উল্লেখ করা হয়নি? ইতিহাসের এই কালো অধ্যায় কেন মুছে ফেলা হলো?
এর একটাই কারণ, আসন্ন প্রজন্ম যেন কখনোই জানতে না পারে যে গান্ধী টুপি পরা “অহিংসার পুরোহিতরা” কী ধরণের রক্তের হোলি খেলেছিল । কেন নেহেরু এবং প্যাটেল এই হিংসা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন ? তারা খুনিকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০শে জানুয়ারী গান্ধীর উপর প্রথম আক্রমণের পর, গান্ধীর জীবনের জন্য কে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা জানা উচিত ছিল। ৩০ জানুয়ারীর পর, পরবর্তী ১০ দিন ধরে, নেহেরু এবং প্যাটেলের পুলিশ গডসের কাছে পৌঁছাতে পারেনি এবং তার পরিচয় খুঁজে পায়নি । কিন্তু ৩০ জানুয়ারী গডসে গান্ধীকে হত্যা করার সাথে সাথেই মাত্র ৬ ঘন্টার মধ্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তার ধর্ম, তিনি কোন জাত এবং কোন ব্রাহ্মণ ছিলেন, এই সমস্ত তথ্য মহারাষ্ট্রের কট্টর কংগ্রেস গান্ধীবাদীরা পেয়েছিল। সেটাও সেই সময় যখন সোশ্যাল মিডিয়া তো দূরের কথা, ফোনও ছিল না। ইন্দিরা গান্ধীর পর শিখ নরসংহার নিয়ে তার পুত্র রাজীব গান্ধীর মন্তব্য ছল,’যদি একটি বটগাছ পড়ে যায়, তাহলে পৃথিবী অবশ্যই কেঁপে উঠবে ।’ তাহলে কি গান্ধী হত্যার পর নেহেরু ও প্যাটেলরা একই মত পোষণ করেছিলেন ?