প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৪ জুন : পাঁচ বছর পঞ্চায়েত প্রধান পদে থেকে শাসক দলের অনেক নেতা-নেত্রী কাটমানির দৌলতে আজ বিত্তশালী বনে গিয়েছেন। বিরোধীদের এমন দাবী যে সবার ক্ষেত্রে সত্য নয় সেই দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন পূ্র্ব বর্ধমানের মেমরি ১ ব্লকের দলুইবাজার ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ঝুমা কোড়া। মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালার দু’কুটুরি ঘরে বসবাস করা ঝুমাদেবীর স্বপ্নটা অবশ্য কাটমানির টাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি, গাড়ি করে বদনামের ভাগিদার হওয়া নয়।বরং ঝুমাদেবী স্বপ্ন দেখেন, পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে পাওয়া অনুদানের অর্থ দিয়ে আরো পড়াশুনা করে স্নাতক হতে।স্নাতক হয়ে একটা সরকারী চাকরি জোগাড় করে নিজেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষেই ঝুমা কোড়া অবিচল রয়েছেন ।
মেমারির দুলুইবার ২ পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম চোঁয়াডাঙা। এই গ্রামেরই ৬ নম্বর সংসদের আদিবাসী মহল্লার বাসিন্দা ঝুমা কোড়া।তাঁর স্বামী সঞ্জয় কোড়া চাষের মরশুমে পরিবারের দেড় বিঘা জমি ও অন্যের কাছ থেকে ভাগে নেওয়া ২-৩ বিঘা জমি চাষ করেন। চাষের মরশুম বাদে অন্য সময়ে সঞ্জয় বালি খাদানে শ্রমিকের কাজ করেন।চোঁয়াডাঙা গ্রামের আদিবাসী মহল্লায় থাকা মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালার দু’কুটুরি ঘরে সঞ্জয় কোড়া তাঁর বৃদ্ধা মা লক্ষ্মীদেবী ,স্ত্রী ঝুমা কোড়া এবং তাঁদের দুই সন্তান সুস্মিতা ও হিমাংশুকে নিয়ে থাকেন। ঝুমার কন্যা সুস্মিতা পাল্লারোড গার্লস স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ে । আর ছেলে হিমাংশু স্থানীয় কলানবগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। কোনরকম আতিশয্য বহির্ভূত ভাবেই কোড়া পরিবারের সকলে দিন গুজরান করেন ।
ঝুমা কোড়া এদিন জানিয়েছেন,স্কুল জীবন থেকেই তাঁর মনে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাতৃভক্তি ও লড়াই সংগ্রামের
বিষয়টি দাগ কাটে।তার পর থেকে মনে প্রাণে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর একান্ত ভক্ত হয়ে ওঠেন ও তৃণমূলের হয়ে কাজ করা শুরু করেন। ঝুমা জানান ,তাঁর বাপের বাড়িও চোঁয়াডাঙা গ্রামেই। তিনি ক্লাস নাইনে পাঠরত কালেই তাঁর সঙ্গে গ্রামেরই যুবক সঞ্জয়ের বিয়ে হয়। তার পর নিজের সংসারের হাল ধরার জন্য তিনিও খেত মজুর কাজ শুরু করেন । আর তাঁর স্বামী বালি খাদানে শ্রমিকের কাজ করা শুরূ করেন। দু’জনের যতসামান্য রোজগারে কোন রকমে তাঁদের সংসার চলতো।সংসারে অভাব থাকায় বিয়ের পর তিনি আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেন নি ।এরই মধ্যে রাজ্য রাজনীতিতে পালাবদল ঘটে। তাঁর প্রিয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন । বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁদের এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস নেতা উত্তম ঘোষ তাঁকে গ্রামের প্রার্থী মনোনিত করেন ।ভোটে জিতে সেবার তিনি সাধারণ সদস্য থাকেন। পরের পঞ্চায়েত ভোটে গ্রামের ৬ নম্বর সংসদের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করে জয়ী হন ।দলীয় নেতৃত্ব তাঁকে দুলুইবাজার ২ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান পদে মনোনিত করেন।ঝুমাদেবী দাবী করেন,সেই থেকে প্রায় সাড়ে চার বছর হল তিনি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ মেনে প্রধান পদের দায়িত্ব সামলে যাচ্ছেন।
ঝুমা কোড়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়,তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হলেই নাকি কাটমানির দৌলতে ভ্যাগ্য ফিরে যায়। প্রাসাদোপম বাড়ি,গাড়ি সবেরই প্রাপ্তি ঘটে যায় তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধানদের । বিরোধীরাতো এমনটাই দাবী করেন । তাহলে তাহলে পাঁচ বছর পঞ্চায়েত সদস্য ও প্রায় সাড়ে চার বছর পঞ্চায়েত প্রধান থেকেও আপনি কেন আপনার ভাগ্যের চাচা ঘোরাতে পারলেন না ? এই প্রশ্নের উত্তরে ঝুমা কোড়া বলেন ,তাঁর মা বোজন্তি কোড়া প্রথম দিন থেকেই তাঁকে সৎ ভাবে পঞ্চায়েত প্রধানের দায়িত্ব পরিচালনার পরামর্শ দিয়ে গেছেন ।
এমনকি কোন ভাবেই যাতে প্রলোভনের ফাঁদে
পা দিয়ে বদনামের ভাগিদার না হই সেই ব্যাপারেরও মা সাবধান করেছেন। তাই মায়ের সেই কথা মনে রেখেই আজ অবধি তিনি ’কাটমানির পারসেন্টেজ’ বুঝে নেওয়া বা অন্য উপায়ে টাকা পয়সা কামানো পথে পা বাড়ান নি বলে প্রধান ঝুমা কোড়া এদিন দাবী করেন । একই সঙ্গে তিনি বলেন ,পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে তিনি যে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান পান সেটা তাঁর কাছে অনেক টাকা। ওই টাকা তাঁর সংসারে যেমন অনেক কাজে লাগে তেমনি তিনি ওই টাকার বলেই নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে পারছেন ।ঝুমা জানান, রবীন্দ্র মুক্ত বিশ্ববিদ্যাল অধীনে পড়াশুনা করে ২০২১ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেছেন । একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এখন উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনা করছেন।প্রত্যেক সপ্তাহের শনি ও রবিবার ক্লাস করতে যান।উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর স্নাতক স্তরের পরীক্ষা দিয়েও তিনি পাস করতে চান ।
পঞ্চায়েত প্রধান ঝুমা কোড়া স্পষ্ট জানিয়ে দেন ,পঞ্চায়েত প্রধান হয়েও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্বামীকে চাষের কাজে সর্বত ভাবে সহযোগীতা করেন।খেত মজুরির কাজেও তাঁর অনিহা নেই।কিন্তু স্বপ্নটা প্রাসাদোপম বাড়ি,গাড়ি এইসবের দিকে নেই । ঝুমা জানান , তাঁর স্বপ্ন সরকারী চাকরি করা । তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী সরকার যদি তাঁকে যে কোন পদে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তিনি বিশেষ ভাবে উপকৃত হবেন। অনৈতিক উপায়ে অর্থ রোজগার করে কিছুদিনের জন্য বড়লোক হওয়া হয়তো যাবে ।কিন্তু একটা চাকরি করে তিনি যদি নিজের জীবন ও সংসার চালাতে পারেন সেটাই তাঁর কাছে অনেক বড় পাওনা হবে বলে ঝুমা কোড়া জানান ।
তৃণমূল কংগ্রেসের কট্টর বিরোধী বিজেপি ও জাতীয় কংগ্রেসের দুলইবাজারের নেতারা ঝুমা কোড়ার সম্পর্কে গুড সার্টিফিকেটই দিয়েছেন । দলুইবাজার ২ পঞ্চায়েত এলাকা নিবাসী বিজেপির কিষান মোর্চার রাজ্য কমিটির সদস্য অসিত চৌধুরী বলেন ,“অর্থের লোভ পঞ্চায়েত প্রধান ঝুমা কোড়ার নেই। কোন আর্থিক দুর্নীতিতে প্রধান জড়িত বা পঞ্চায়েতে কোন কাজের জন্য যাওয়া কারুর কাছে প্রধান টাকা পয়সা দাবী করেছেন এমনটাও কোনদিন তাঁরা শোনেন নি । অসিত বাবু এও বলেন ,তিনি নিজে কোন কাজ নিয়ে গিয়েও প্রধানের কাছে খারাপ ব্যবহার পাননি । নাহ্য দাবী দাওয়া থাকলে দল মত নির্বিশেষে প্রধান সবার কাজই করেদেন।তবে পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান গৌতম রায় সম্পর্কে এলাকার সবার ধারনা উল্টো বলেই অসিত চৌধুরি দাবী করেছেন“।অন্যদিকে জাতীয় কংগ্রেসের দলুইবাজার ২ অঞ্চলের সভাপতি
শিবাজী চৌধুরী বলেন , “তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত অন্য পঞ্চায়েতের প্রধানদের মতো অর্থ লোভী নয় ঝুমা কোড়া । এমনকি তাঁর স্বামীও অর্থ লোভী নয়।কাটমানি খাওয়া থেকে নিজেদের দুরে রেখেছেন বলেই প্রধান ঝুমাদেবী ও তাঁর স্বামী এখন মাটির বাড়িতে থেকেই আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাবন করেন । তবে উপ-প্রধান এর ঠিক উল্টো পথেই চলছেন।শিবাজী চৌধুরী এও জানান, বিরোধী দলের নেতা হয়েও কোন কাজের ব্যাপারে প্রধান ঝুমা কোড়ার কাছে গিয়ে তাঁকে নিরাশ হতে হননি ।’
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যের মুখপত্র দেবু টুডু বলেন, ‘বিরোধীরা তৃণমূল কংগ্রেসে পরিচালিত
পঞ্চায়েতের প্রধানদের দিকে সব সময়েই অভিযোগের আঙুল তোলেন । কিন্তু তা যে সত্য নয় , ঝুমা কোড়াই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ । এমন পঞ্চায়েত প্রধানরাই গ্রাম বাংলার উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।’।