এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,২৬ মে : কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশের প্রতিটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ । অনুপ্রবেশকারীদের নথিপত্র বাছাইয়ে জন্য ৩০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন তিনি । ৩০ দিনের পরে, যদি তাদের নথিপত্র যাচাই না করা হয়, তাহলে তাদের সরাসরি নির্বাসনের মুখোমুখি হতে হবে বলে জানা গেছে । তারপর থেকে, দিল্লি,আসাম,রাজস্থান, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা,মধ্যপ্রদেশ এবং ওড়িশার মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সনাক্ত এবং আটক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে । “অপারেশন পুশইন”-এর মাধ্যমে শত শত রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ঢুকিয়েও দেওয়া হচ্ছে । কিন্তু বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এনিয়ে তৎপরতা দেখা গেলেও পশ্চিমবঙ্গ,কেরালা, কর্ণাটক তামিলনাড়ু প্রভৃতি অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে । সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপি শাসিত কিছু রাজ্যে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের বিতারণের কিছু পরিসংখ্যান নিচে তুলে ধরা হল ।
গুজরাট :
শুধুমাত্র এপ্রিল মাসে গুজরাটের সুরাট ও আহমেদাবাদ থেকে গ্রেফতার হয়েছে ১০২২ জন রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি। এদের অধিকাংশ পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এদের কাছে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আধার কার্ড। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ এই পরিসংখ্যান দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন,’কেবল সুরাট এবং আহমেদাবাদ থেকেই গ্রেফতার হয়েছে এত অবৈধ বাংলাদেশি নাগরিক। তাহলে সমগ্র দেশ জুড়ে কত বাংলাদেশি নাগরিক ছড়িয়ে রয়েছে?পশ্চিমবঙ্গই বাংলাদেশি জঙ্গিদের, অবৈধ নাগরিকদের সেফ করিডোর অথচ পশ্চিমবঙ্গে কেন অদ্ভুতভাবে এই ধরণের অভিযান করা হচ্ছে না? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে কোনো দায়িত্ব নেই ?’
উত্তরপ্রদেশ :
কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর উত্তরপ্রদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে শুরু হয়েছে বড় পরিসরের তল্লাশি অভিযান।উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নির্দেশে সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড (এটিএস), স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) ও অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থাগুলো একযোগে অভিযান চালাচ্ছে। মূল লক্ষ্য— অবৈধভাবে বসবাস করা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা নাগরিকদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। ইউপি পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের প্রাথমিক অনুমান, উত্তরপ্রদেশে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা নাগরিক অবৈধভাবে বসবাস করছে। তাদের দাবি, কিছু অনুপ্রবেশকারী চক্রের সঙ্গে বিদেশি অর্থ জড়িত, যা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হুমকি হয়ে উঠছে।
তাদের দাবি, এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দুর্বল করার লক্ষ্যে বিদেশ থেকে মোটা অর্থের তহবিল আসছে এসব অনুপ্রবেশকারী সিন্ডিকেটগুলোর কাছে।
নেপাল সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় বিশেষ নজরদারি চালানো হচ্ছে। এছাড়া রাজধানী লখনৌ, গৌতম বুদ্ধ নগর, গাজিয়াবাদ, মীরাট, কানপুর, সাহারানপুর ও মুজাফফরনগর— এসব শহরে অনুপ্রবেশকারীদের উপস্থিতি বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে চলতি মে মাস পর্যন্ত ইউপিতে মোট কতজন অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানো হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি৷
রাজস্থান :
রাজস্থানে এযাবৎ অন্তত ১০০১ জন অবৈধ বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।এদের মধ্যে ৩৭৬ জন পুরুষ,২৮৪ জন মহিলা এবং
৩৪১ জন শিশু । রাজস্থান পুলিশ এই অবৈধ অভিবাসীদের প্রথম দলকে বাংলাদেশে নির্বাসনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়েছিল ।
আসাম ও ত্রিপুরা :
গত এক দশকে ভারতে প্রবেশের সময় বহু রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের একটি বড় অংশই বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে । অনুপ্রবেশ ও ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরির করিডর হিসাবে তারা মূলত পশ্চিমবঙ্গকে ব্যবহার করে । গত মাসে আসাম ও ত্রিপুরায় রোহিঙ্গাদের দুটি দলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু এই রোহিঙ্গারা উল্টো ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরছিল । এতোদিন তারা ভারতেই ছিল। ২৯শে মে তিনটি রোহিঙ্গা পরিবারকে গ্রেপ্তারের পর আসামের সিলচর বন্দীশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পরিবারগুলো বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিল।
জানা গেছে, ২০১২ সালে তারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসে। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গে থাকলেও পরবর্তীতে তারা উত্তর ভারতের জম্মুতে চলে যায়। জম্মুতে বিভিন্ন সময়েই অনেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। আসামের পুলিশ দ্য ডিপ্লোম্যাটকে জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে রোহিঙ্গাদের এই দলটি জম্মুর একটি শরনার্থী শিবিরে ছিল। কিন্তু তারা এখন বাংলাদেশে ফিরতে চায়। এর আগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসতো কিন্তু এবার তারা উল্টো ফেরত যাচ্ছে। ৩রা মে ২৪ রোহিঙ্গার আরেকটি দলকে গ্রেপ্তার করে ত্রিপুরা পুলিশ। তারাও কৈলাশাহার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিল। তদন্তের পর জানা যায় এই রোহিঙ্গারাও জম্মু থেকে বাংলাদেশে ফিরছিল।
শুধু ভারতেই নয়, বাংলাদেশেও ভারত থেকে ফেরা রোহিঙ্গারা গ্রেপ্তার হচ্ছে । গত ১২ই মে বাংলাদেশের মৌলভীবাজারে রোহিঙ্গাদের একটি দলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে ফেরার চেষ্টা করছিল। গত ২৪শে মে ক্যাম্প-২৬ থেকে সাত রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর একদিন আগেই তারা ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরেছিল। গ্রেপ্তারের পর তাদেরকে কুতুপালং-এর ইউনএইচসিআর ট্রানজিট সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
পশ্চিমবঙ্গ :
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিরা পশ্চিমবঙ্গকে করিডর হিসাবে ব্যবহার করলেও মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কেন তাদের বিরুদ্ধে নরম মনোভাব দেখাচ্ছেন ? ২০২৬ সালে রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচনের আগে কি ভোটব্যাংক হারানোর ভয় পাচ্ছে এরাজ্যের শাসকদল ? গত বছর সেপ্টেম্বরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছিলেন,পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশির সংখ্যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ । কিন্তু বাংলাদেশিদের এই অনুপ্রবেশ রুখতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সীমান্তে বেড়া নির্মাণের জমি দিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। শুভেন্দু বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে ৭২টি জায়গা আছে যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে (বিএসএফ) ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর বেড়া দেওয়ার জন্য জমি দেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জমি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি দেননি। শুধু ভোট ব্যাংক এবং তোষণের রাজনীতির জন্যই তিনি এই জমি দিচ্ছেন না।’
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শুভেন্দু অধিকারী বলেন,’গত ২-৩ মাসে, আসাম পুলিশ এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ অনেক বাংলাদেশী, রোহিঙ্গা এবং চরমপন্থীকে গ্রেপ্তার করেছে। অথচ এরাজ্যের ৫০-৫৫টি বিধানসভা নির্বাচনী এলাকা এবং ৩০-৩৫টি থানা রয়েছে যেখানে জনসংখ্যার পরিবর্তন হয়েছে… এর জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি দায়ী। তিনি পুলিশ মন্ত্রী (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন ।’ তিনি অভিযোগ তোলেন,মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার সরকার অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী এবং রোহিঙ্গা অভিবাসীদের রাজ্যে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে।।
তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়,রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে প্রবল অনীহা দেখা যাচ্ছে সিপিএম শাসিত কেরালা, কংগ্রেস শাসিত কর্ণাটক এবং ডিএমকে শাসিত তামিলনাড়ু রাজ্য সরকারগুলিকে ।
এদিকে বহু রোহিঙ্গা নিজেরাই ভারত ছেড়ে পালাতে শুরু করে দিয়েছে । কিন্তু হঠাৎ করে কী হলো যে রোহিঙ্গারা ভারত থেকে পালাচ্ছে? বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিল্লিতে থাকা এক রোহিঙ্গা জানায় যে গত কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছে জম্মুতে থাকা রোহিঙ্গারা। এরইমধ্যে দুই হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন রুটে বাংলাদেশে পৌঁছেছেও। মূলত ভারত সরকারের বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপের কারণেই তারা ভয়ে পালাচ্ছে । কেন্দ্র সরকার রোহিঙ্গাদের বন্দীশিবিরে ঢোকাতে চাইছে এবং এরপর মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করছে । বাংলাদেশের অবস্থাও ভাল নয় কিন্তু তারা অন্তত রোহিঙ্গাদের বন্দী করে রাখছে না।
ওই রোহিঙ্গা হাসিনা বেগম নামের একজনের উদাহরণ দেয় । বলেন, হাসিনা বেগম প্রায় এক বছর ভারতের জেলে আটক ছিল। তাকে তার স্বামী ও তিন সন্তানের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। গত মাসে তাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। জাফর আলম নামের আরেক রোহিঙ্গাকেও সম্প্রতি মিয়ানমারে ফেরত দেয়া হয়েছে। গত বছরের শেষ দিক থেকে জম্মুতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একশন নিতে শুরু করে পুলিশ। এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার হয়েছে সেখানে। ফলে গ্রেপ্তার এবং মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর আতঙ্কে ভুগছে ভারতে আসা রোহিঙ্গারা।।

