🌼 “যােগিরাজের সাধনার প্রাথমিক লক্ষ্যস্থলই হলাে কুটস্থ। এই কথাটির দ্বারায় যােগিরাজ বলতে চেয়েছেন যে কুটস্থ ব্যতিরেকে আত্মসাধন সম্ভব নয়। যােগিগণের কাছে কূটস্থই আত্মসাধনার পীঠস্থান । আত্মসাধনার পীঠস্থানরূপ এই কূটকে জানাই জ্ঞান এবং কূটস্থের উর্ধ্বে যে অব্যক্ত অবস্থা তাকে জানাই বিজ্ঞান । কূটস্থ হল উভয় অবস্থার অর্থাৎ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রান্তসীমা । আত্মসাধনার পীঠস্থানরূপ প্রান্তসীমারূপী এই কুটস্থের নীচের দিকে ব্যক্তবস্থা এবং উধ্বে অব্যক্তাবস্থা । কপালের মধ্যভাগে দুই ভ্রুর মাঝে নাসাগ্রে অপরিবর্তনশীল ও অবিনাশী এই সাধনারপীঠভূমি পৰ্যন্তই যােগিদের কর্ম।
অর্থাৎ কর্মের দ্বারা প্রাণকর্মের দ্বারা এই কূট পৰ্যন্তই যােগিদের যাতায়াত । এই পৃথিবীতে যেমন তিন ভাগ জল ও একভাগ স্বল তেমনি ব্রহ্মেরও তিনভাগ নিশ্চল ও একভাগ চঞ্চল । ব্রহ্মের এই একভাগ চঞ্চলতায় কুটস্থের প্রকাশ অর্থাৎ এই একাংশ থেকেই নিখিল জগতের প্রকাশ । কুটস্থের উর্ধ্বে যে বাকি তিনভাগ ব্রহ্মের নিশ্চল অবস্থা তা অব্যক্ত।
যিনি কূটস্থের নীচে এবং উর্বের উভয়ভাব জ্ঞাত হয়েছেন তিনিই জ্ঞান ও বিজ্ঞান দ্বারা তৃপ্তাত্মা এবং এইরূপে কুটস্থকে বিদিত হওয়ারূপ লাভ করে যিনি জীতেন্দ্রিয় হয়েছেন তার সর্বত্রে সমদৃষ্টি হওয়ায় তিনি যুক্ততম যােগী।
তাই যােগিরাজ বলছেন সাধনার পীঠভূমি এই অবিনাশী কূটকে অবশ্যই জানা চাই। তবে এই কূটকে জানতে হলে অবশ্যই গুরুপদেশের প্রয়ােজন। যিনি এই পীঠভূমিরূপী কূটকে জেনেছেন তিনিই গুরু এবং এইপ্রকার গুরুর কাছ থেকে উপদেশ না পাওয়ায় যিনি কূটকে জানতে সক্ষম হন নি তিনি অন্ধ । সাধারণ মানুষ এই দুই চক্ষুর ধারায় জগতকে দেখে থাকে, কিন্তু এই দুই চক্ষুর অতীতে কূটস্থরূপী সাধনার পীঠভূমি যে তৃতীয় চক্ষু আছে তার হদিশ জানে না। ফলে মায়াময় এই জগতের অতীতে যে অব্যক্তরূপী পরমাত্মভাব আছে তার দর্শন হয় না ।
চক্ষুর ধর্মই হল দেখা । যােগিগণ কুটস্থরূপী একচক্ষুর মাধ্যমে সেই পরমাত্মভাব দর্শনে তন্ময়প্রাপ্ত হয়ে সেখানেই অবস্থান করেন এবং ক্রমে পরমানন্দভাবের অতীতে অব্যক্তে লীন হয়ে যান। যতক্ষণ পর্যন্ত কুটস্থরূপী চক্ষুর মাধ্যমে সেই অনির্বচনীয় মহানন্দভাবের দর্শন হয় ততক্ষণও দ্বৈতাবস্থা, কিন্তু কূটস্থের উর্ধ্বে যে মহাশূন্যরূপী অব্যক্ত অবস্থা তাতে লয় প্রাপ্ত হলে অদ্বৈতাবস্থা। অর্থাৎ কূটস্থের নীচে ব্যক্তাবস্থা হত্যায় দ্বৈতাবস্থা এবং কুটস্থের উর্ধ্বে মহাশূন্যরূপী অব্যক্তাবস্থায় অদ্বৈতাবস্থা ।”
অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত “শ্যামাচরণ ক্রিয়াযোগ ও অদ্বৈতবাদ”, পৃষ্ঠা-১৭/১৮ থেকে গৃহীত ।