জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বর্ধমান,১৭ জানুয়ারী :
পাড়ার দুর্গাপুজো। তারস্বরে ঘোষক মাইকে সমানে চিৎকার করে চলেছে – আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে আজকের যাত্রাপালা……। আপনারা দয়া করে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করুন।গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন উৎসবে গ্রামের ছেলেদের অভিনীত যাত্রা ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ‘ফিমেল’ অবশ্য কাছাকাছি সাজঘরগুলি থেকে ভাড়া করা হয়। অথবা রাস্তার উপর দিয়ে ঘোষণা করতে করতে চলেছে প্রচারবাহী রিক্সা বা চারচাকা গাড়ি – আগামী অমুক তারিখে অমুক গ্রামের মঞ্চ মাতাতে আসছে কলকাতার সুবিখ্যাত….. যাত্রা কোম্পানি। হ্যাণ্ডবিল কুড়ানোর জন্য গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটছে গ্রামের কচিকাচারা। কলকাতার পেশাদার যাত্রা দলগুলোর যাত্রা দেখার জন্য যাত্রামোদী দর্শকরা উদগ্রীব হয়ে থাকত। নিজেদের প্রিয় শিল্পী সংশ্লিষ্ট পালার সঙ্গে যুক্ত থাকলে তো একটা আলাদা উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। গত তিন বছর ধরে বাংলার বুক থেকে এই দৃশ্য কার্যত উধাও ।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন,’যাত্রায় লোকশিক্ষা হয় ।’ দীর্ঘদিন ধরে টিভি সিরিয়ালের এবং গত তিন বছর ধরে করোনার দাপটে প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রার মত লোকশিক্ষাও আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। পার্থক্য একটাই প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’-র মত অনলাইনে কিছুটা হলেও শিক্ষা পাচ্ছে। আর শিক্ষকরা তাদের বেতন নিয়মিত পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যাত্রা শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত কয়েক হাজার মানুষ আজ চরম ক্ষতিগ্রস্ত। অনুমতি না পাওয়ার ফলে রোজগারের পথ তাদের বন্ধ।
একটা সময় যাদের অভিনয় দেখার জন্য শীতের সন্ধ্যায় প্রবল ঠান্ডা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ভিড় করত, যারা ছিল যাত্রামোদী দর্শকদের ‘হার্টথ্রব’ উপার্জনের পথ হারিয়ে আর্থিক দিক দিয়ে আজ তারা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। কোনো কাজ ছোট না হলেও শিল্পী সুলভ ‘ইগো’ তাদের বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে নেওয়ার পথে চরম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ‘সো’ করতে গিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অনেকের একটা ‘ফ্যান বেস’ গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিক ভাবেই অনভ্যস্ত পরিবেশে অন্য ধরনের কাজ করতে গিয়েও তাদের সমস্যায় পড়তে হয় ।
এতো গেল অভিনয় শিল্পীদের সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চে যারা যন্ত্র সঙ্গীত বাজান তারাও কালের নিয়মে অন্য কাজে অনভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এমনকি যারা যাত্রাদলে টুকটাক ফরমাশ খাটে অথবা প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে প্রোগ্রাম বিক্রি করে নিজেদের আয়ের পথ খুঁজে নিত যাত্রা বন্ধ থাকায় তারাও আজ গভীর সমস্যায় পড়ে গেছে ।
যেসব প্যাণ্ডেল ব্যবসায়ীরা যাত্রার জন্য প্যাণ্ডেল তৈরি করত করোনা পরিস্থিতিতে তারাও সমস্যায়। বিবাহ বা অন্য কোনো উৎসবে টুকটাক কাজ পেলেও মূল আয়টা তাদের যাত্রার প্যাণ্ডেল তৈরি করেই হতো। প্যাণ্ডেলের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরাও মোটামুটি কিছু পয়সার মুখ দেখতে পেত। আজ তাদেরও আয় বন্ধ।
প্রতিবছর যাত্রা শুরুর আগে শিল্পীদের অগ্রিম দিয়ে ‘বুক’ করা, মহড়ার আয়োজন করা সহ বেশ কিছু খাতে প্রযোজকদের আগাম খরচ করতে হয়। পরবর্তীকালে ‘সো’ করে সেই খরচ উঠে আসে। লাভ হলে পরবর্তী ‘সিজন’-এ আবার তারা বিনিয়োগ করতে উৎসাহি হয়ে ওঠে। অথচ করোনাজনিত কারণে গত প্রায় তিন বছর ধরা যাত্রা বন্ধ থাকায় বিনিয়োগ করে অনেক যাত্রা প্রযোজক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে অনেকেই নতুন করে এই শিল্পে বিনিয়োগ করতে চাইছেনা ।
এছাড়া যাত্রা প্যাণ্ডেলের ভিতরে বা বাইরে লজেন্স, বাদাম বা চানাচুর বিক্রেতারাও আছে। এই সময় তাদের কিছু অতিরিক্ত আয় হয়। সেই অতিরিক্ত আয়ও আজ বন্ধ। অর্থাৎ যাত্রা আয়োজনের অনুমতি না থাকায় অনেকের আয় বন্ধ।
ধীরে ধীরে কোভিড প্রোটোকল এবং পঞ্চাশ শতাংশ হাজিরা মেনে মেলা, খেলা, সিনেমা, থিয়েটার, সিরিয়ালের শুটিং, শপিং মল সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চালু হলেও এবং পঞ্চাশ শতাংশ যাত্রী নিয়ে ট্রেন-বাস চলাচল শুরু করলেও কোনো এক অজানা কারণে পাওয়া যাচ্ছেনা যাত্রা অনুষ্ঠান আয়োজন করার অনুমতি। স্বাভাবিক ভাবেই আয় হারিয়ে কার্যত অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে যাত্রা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার পরিবার ।
অনেক আশা নিয়ে তিন-চার বছর আগে যাত্রা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন এযুগের এক শক্তিশালী অভিনেত্রী নবগতা স্নেহা ভট্টাচার্য। মূলত তিনি সিরিয়ালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেটুকু সামান্য সুযোগ তিনি পেয়েছেন তাতে তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছে যাত্রামোদী দর্শক। সেই স্নেহা বললেন – সমাজের প্রতি আমাদেরও একটা দায়বদ্ধতা আছে। রাজ্য সরকার যেখানে ক্রমবর্ধমান করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন সেখানে আমরাও সরকারের প্রচেষ্টার পাশে আছি। তার পরেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ ধীরে ধীরে সবকিছু যখন চালু করে ‘নিউ নরমাল’-এ আসার চেষ্টা হচ্ছে তখন যাত্রা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অনুষ্ঠান করার সুযোগ দেওয়া হোক। নাহলে এরপর আমাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে ।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে যাত্রা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও গত পঁচিশ ধরে যে জুটির অভিনয় দেখার জন্য যাত্রামোদী দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে সেই অনল-কাকলি জুটির অন্যতম অনল চক্রবর্তী বললেন – আমাদের তো আয়ের অন্য কোনো উৎস নাই। যাত্রার মাধ্যমেই আমাদের রুজি-রুটি যোগাড় হয়। এখানেই আমরা তিনটে ‘সিজন’ ধরে মার খেয়ে যাচ্ছি। যাত্রা শিল্পীদের ও শিল্পের জন্য মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর অবদান অস্বীকার করা যাবেনা। তার কাছে অনুরোধ দয়া করে আমাদের মঞ্চটা ফিরিয়ে দিন। আমরা অন্তত খেয়ে-পড়ে বাঁচি। অবশ্যই সমাজের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা আমরা কখনোই ভুলব না ।
একই কথা শোনা গেল বেশ কিছু যাত্রামোদী দর্শকদের মুখে। তাদের বক্তব্য যারা যাত্রার দর্শক তাদের মূলত ভ্যাকসিন হয়ে গেছে। তাহলে অনুমতি দিতে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া যেভাবে বছরের পর বছর লোকশিক্ষার অন্যতম এই প্রাচীন মাধ্যমটি অবহেলিত হয়ে চলেছে তাতে এই মাধ্যমটি অচিরেই বিষ্মৃতির অন্তরালে চলে যাবে। সবার স্বার্থে শিল্পটিকে বাঁচানোর জন্য সরকার দ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করুক ।।