“প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য
আছে । পাশ্চাত্য দার্শনিক ও চিন্তাশীল মনীষীদিগের
মতবাদের সহিত ভারতীয় দার্শনিকদের চিন্তাধারার পার্থক্য বেশ পরিস্ফুট । পাশ্চাত্য দর্শনে যে সব তত্ত্ব আলোচিত হইয়াছে সেগুলির সত্য আধুনিক, সেগুলি ব্যক্তিবিশেষের মত মাত্র। ইউরোপীয় চিন্তাশীল মনীষীগণ অন্তর ও বহির্জগতে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যদর্শনে মুগ্ধ হইয়া কেবলমাত্র বুদ্ধির সাহায্যে এই জগতের কারণ ও তাহার স্বরূপ নির্ণয় করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। তাহারা স্বীয় বুদ্ধি অনুসারে জগতের কারণ সম্বন্ধে নানাপ্রকার অনুমান, বহুবিধ মত এবং নানাবিধ সংজ্ঞা নিৰ্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা নিজ নিজ ভাবপ্রবণতায় স্ব স্ব মনকে ছাড়িয়া দিয়া ঈশ্বর,জীব,জগৎ,অদৃষ্ট ও পুরুষকার সম্বন্ধে নানাবিধ মতবাদ প্রচার করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের এই সমস্ত মতবাদ ক্রমে পুস্তকাকারে পরিণত হইয়া দর্শনশাস্ত্র নামে অভিহিত হইয়াছে। তাঁহাদের এই মতগুলি আনুমানিক,শুধু বুদ্ধির উপর,কেবল পরোক্ষ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু হিন্দুদর্শনের প্রকৃতি পাশ্চাত্যদর্শন হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। পাশ্চাত্য দর্শন যে পদ্ধতিতে সত্যে উপনীত হইতে চেষ্টা
করিয়াছেন, হিন্দুদর্শনের সত্যানুসন্ধানের পদ্ধতিও তাহা হইতে ভিন্ন। হিন্দুদর্শনের মূল তত্ত্বগুলি যোগলব্ধ অপরোক্ষজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত; পাশ্চাত্য দর্শন যেখানে অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া কেবল বুদ্ধির দ্বারা সত্যে পৌঁছাইতে প্রয়াস পাইয়াছে, হিন্দু দর্শনশাস্ত্রকারগণ সেখানে বুদ্ধির উপরে যাইয়া সেই সত্য আপনার হৃদয়ে উপলব্ধি করিয়াছেন। তাহার নিকট সত্য আনুমানিক নয়, শুধু একটা মত নয়, সত্য তাহার নিকট হস্তামলকবৎ প্রত্যক্ষ।
হিন্দুদর্শনে যুক্তি,তর্ক,অনুমান প্রভৃতি প্রমাণের স্থান যথেষ্ট আছে, কিন্তু হিন্দুদর্শন যুক্তি ও অনুমানলব্ধ মতবাদে সন্তুষ্ট থাকিতে পারে নাই। হিন্দুদর্শনে যে সত্য ঘোষিত হইয়াছে, হিন্দু দার্শনিক তাহা কেবল যে যুক্তি ও তর্কের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন তাহা নহে,তিনি তাহা আপন হৃদয়ে উপলব্ধি করিয়াছেন। সত্যের উপলব্ধি বিষয়ে তিনি বুদ্ধির সাহায্য লইয়াছেন বটে, কিন্তু সে কিছুদূর মাত্র। আপন হৃদয়ে সত্য প্রত্যক্ষ করিবার নিমিত্ত বুদ্ধি ব্যতীতও তাঁহাকে নিতান্ত প্রয়োজনীয় অনেকগুলি উপায় অবলম্বন করিতে হইয়াছে, সেই উপায়গুলি তাঁহাকে সৎগুরুর নিকট হইতে শিক্ষালাভ করিতে হইয়াছে । বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীর মত অধ্যাপকের বক্তৃতা শুনিয়া কেবল পুঁথিগত বিদ্যার বলে জ্ঞান অর্জন করিতেন না। তাঁহার মন, প্রাণ,দেহকে ঋতময়, সত্যময় করিয়া তুলিতে হইত এবং সৎগুরুর নিকট হইতে যে সত্যটি লাভ করিতেন, সেই সত্যটি আপন হৃদয়ে অনুভব করিয়া জ্ঞানলাভ করিতেন। এইরূপে সৎগুরু আপন আপন হৃদয়ে উপলব্ধ সত্যগুলি সত্যধারণক্ষম শিষ্যদিগকে উপদেশ দিতেন। যাঁহাদের মন,প্রাণ,বুদ্ধি সত্যধারণোপযোগী উৎকর্ষলাভ না করিত, সৎগুরু সেই সমস্ত শূদ্রপ্রকৃতিসম্পন্ন লোকদিগকে জ্ঞান উপদেশ করিতেন না । কারণ,সত্যজ্ঞান লাভ করিতে হইলে যে প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজন, সে শিক্ষা যাহাদের নাই তাহারা সেই জ্ঞান সম্বন্ধীয় উপদেশ শুনিয়া আপন আপন বুদ্ধি অনুসারে সেই সত্যের খামখেয়ালি বিকৃত ব্যাখ্যা করিতে পারে ।”
স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি কর্তৃক প্রণীত গীতার তত্ত্ব হইতে সংগৃহীত ।