জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বর্ধমান,০৭ ফেব্রুয়ারী :
সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ প্রকৃতির সৌন্দর্যের টানে পাহাড় থেকে সাগরে ছুটে বেড়ায়। কাঁধে দামি ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে জঙ্গলে। প্রকৃতির ছোট-বড় সব সৌন্দর্য ক্যমেরাবন্দী হয়। কেউ কেউ আবার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছুটে যায় বিদেশের বিখ্যাত সব জায়গায়। কিন্তু বাড়ির এক টুকরো ছাদের মধ্যেই যে অপার সৌন্দর্য সৃষ্টি হতে পারে সেটা অনেকেরই মাথায় থাকেনা। নিজের সৃষ্টি সৌন্দর্য রাজ্যের মধ্যে যে একটা আলাদা আনন্দ আছে সেটাও অনেক সময় উপলব্ধি হয়না। অথচ দীর্ঘদিন ধরে সেটাই করে দেখাচ্ছেন বর্ধমান পুরসভার ১৯ নং ওয়ার্ডের অসিত রাউথ।
ঠিক কবে শুরুটা হয়েছিল সেটা নির্দিষ্ট ভাবে অসিত বাবু বলতে পারলেন না। তবে এটুকু বললেন খুব অল্প বয়সে মা’কে ছাদে ফুল গাছ বসাতে ও তাদের পরিচর্যা করতে দেখেছিলাম। যদিও সেটা বোঝার মত বয়স তখনও তার হয়নি। মায়ের পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করে মায়ের আঁচল ধরে থাকা অসিত ফুলের প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করে। মায়ের পাশাপাশি নিজেও কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলের পরিচর্যা শুরু করে। মা না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পর অসিত নিজেই ফুল সাম্রাজ্যের প্রতি মনোযোগ দেয়। পরবর্তী সময়ে তার একমাত্র আদরের সন্তান ‘বাবু’ অর্থাৎ শ্বেতা বাবার কোলে চেপে বাবার ফুল পরিচর্যা করতে দেখে নিজেও বাবার মত ফুলের প্রেমে পড়ে যায়। এইভাবেই বর্ধমানের পুরনো রাজ স্কুল সংলগ্ন রাউথ পরিবারের ছাদে গড়ে উঠেছে রকমারি ফুলের আস্ত একটা ফুল বাগান।
টবের মধ্যে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা থেকে শুরু করে সব ধরনের মরশুমি ফুল গাছ শোভা পাচ্ছে রাউথ পরিবারের ছাদে। ফুল গাছগুলি আবার টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো আছে। রাতের বেলায় গাছগুলোর উপর রাখা টুনি বাল্বগুলো জ্বলতে শুরু করলে এক রহস্যময়ী মোহময়ী পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দেখলে মনে হবে শহরের কোনো নামী পাঁচতারা হোটেলে ধনী পরিবারের কোনো এক অনুষ্ঠান হচ্ছে। শুধু কি তাই, ফুল বাগান হয়ে ওঠে ‘বাবু’-র বান্ধবীদের সেলফি তোলার জায়গা। ফুলের মত একদল পরী যখন ফুলের বাগানে সেলফি তোলে তখন দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। সত্যিই সে এক অপরূপ দৃশ্য।
শুধু কি ফুল গাছ? সেখানে আছে বিভিন্ন ফলের গাছ। পাতিলেবু, কমলালেবু থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের লেবু, কুল সহ সম্ভাব্য ফলের গাছ সেখানে শোভা পায়। মাঝে মাঝে দু’চারটে ফুলকপি ও বাঁধাকপি, বীট, গাজর, ধনেপাতা, লাউ, কুমড়ো, শীম ইত্যাদি সব্জীও বসানো হয়। প্রতিবেশিরাতো মাঝে মাঝে ধনেপাতা নিয়ে যায়।
জানা গেলো প্রায় চার শতাধিক টবের মধ্যে শোভা পাচ্ছে ফুল গাছগুলো। মাটি কিনে আনা হয় বাজার থেকে। তারপর তার সঙ্গে গোবর, খোল সহ বিভিন্ন জৈব সার ও খুব অল্প পরিমাণ রাসায়নিক সার মেশানো হয়। মাটি তৈরি হওয়ার পর প্রতিটি টব মাটি ভর্তি করা হয়। এরপর সেখানে শখের ফুল গাছ বসানো হয়। শুধু গাছ বসিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়না। নিয়মিত সেগুলো পরিচর্যাও করা হয়। আবার যে গাছগুলো নষ্ট হয়ে যায় সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। যত্ন করে রেখে দেওয়া মাটি পরে আবার ব্যবহার করা হয়। তবে শীতের মরশুম শেষ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেভাবে আর রকমারি ফুল গাছ শোভা পাবেনা রাউথ বাড়ির ছাদে। সেটা ভাবতেই একরাশ বিষণ্নতা গ্রাস করে পিতা-পুত্রীকে।
ফুলের প্রতি ভালোবাসার কথা বলতেই কিশোরীসুলভ লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে অসিত কন্যা ‘বাবু’। তারপর বলে – বাবাকে দেখেই এই আকর্ষণ। সত্যিই খুব ভাল লাগে। এর মধ্যে পাওয়া যায় একরাশ আনন্দ। বান্ধবীরা যখন সেলফি তুলতে আসে তখন গর্বে বুক ফুলে ওঠে।
পেশায় সাংবাদিক অসিত বাবু বললেন, খবর সংগ্রহের জন্য ব্যস্ততা আছেই। যখন ফুলগাছগুলোকে দেখি তখন সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে যায়। তবে দিনের বেলায় সুযোগ সেভাবে পাইনা বলে রাতে হ্যালোজেন জ্বেলে গাছ পরিচর্যা করি। খুব ভাললাগে যখন আমার বাড়ির ছাদের গাছগুলো দেখতে অনেকেই আসে। তার আক্ষেপ মোবাইলের আকর্ষণে পড়ে এই সৌন্দর্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কথা বলতে বলতে গাছ পরিচর্যায় মন দেন অসিত বাবু। পাশে থাকা ‘বাবু’ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।।