প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৭ ফেব্রুয়ারী : ‘ভিক্ষা-অন্নে বাঁচাব বসুধা/ মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা’ -লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । কিন্তু বাস্তবে ভিক্ষা করেই এলাকার মানুষের ‘দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা’ মিটিয়েছিলেন পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামের দধিয়া গ্রামের মহান বৈষ্ণব সাধক গোপাল দাস বৈরাগ্য । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খাজনা আদায়ের নামে সীমাহীন শোষণ আর লুণ্ঠনের পাশাপাশি সেই সময় (১৭৬৮-১৭৬৯) অনাবৃষ্টির কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে রাজ্যজুড়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ । অনাহারে দিন কাটছিল কেতুগ্রাম-১ ব্লকের পালিটা গ্রাম পঞ্চায়েতের দধিয়া গ্রামের বাসিন্দাদের । ১১৭৬ বঙ্গাব্দে সেই মন্বন্তরের সময় আশপাশের এলাকার পাশাপাশি বীরভূমের কেঁদুলি পর্যন্ত গিয়ে ভিক্ষা করে চাল সংগ্রহ করে আনতেন বৈষ্ণব সাধক গোপাল দাস বৈরাগ্য । সেই অন্নে মহোৎসবের সূচনা করে মাসাধিক কাল গ্রামবাসীদের ক্ষুধা মিটিয়েছিলেন তিনি । পরবর্তী কালে গোপাল দাস বৈরাগ্যের আশ্রম ‘দধিয়া বৈরাগ্যতলা’ হিসাবে পরিচিত হয় । তাঁরই স্মরণে প্রতি বছর মাকুড়ি সপ্তমীর পরদিন থেকে ‘দধিয়া বৈরাগ্যতলা’য় মেলা হয় । সাতদিন ধরে এই মেলা চলে । মন্বন্তরের সময় গোপালদাস বাবাজির মহোৎসবকে স্মরণ করতে সাধনপীঠে এসে রান্না করে খেয়ে বাড়ি যান দুরদুরান্তের গ্রামের বাসিন্দারা ।
এবছর শুক্রবার থেকে মেলার সূচনা হয়েছে । পূর্ব বর্ধমান জেলার পাশাপাশি বীরভূম, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ জেলা থেকেও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি অন্য সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষ এসেছেন দধিয়া বৈরাগ্যতলায় । দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন বৈষ্ণব সাধকরা । মেলায় ৫০০ -এর বেশি বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ভান্ডারা দেওয়ার জন্য আখড়া করেছেন । চারদিন ধরে মেলা প্রাঙ্গনের দুই প্রান্তের দুটি মঞ্চে সারাদিনব্যাপী কীর্তন-বাউল-কবি গান , সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়েছে ।
শোনা যায়,গোপাল দাস বাবাজী ১১৪৩ বঙ্গাব্দে বৈষ্ণব সাধক সন্তরাম আউলিয়ার কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। দীক্ষার পর তিনি দেশ ভ্রমণে বের হন । আর তখনই তিনি কেতুগ্রামের দধিয়া গ্রামে আসেন । গ্রাম পছন্দ হয়ে যাওয়ায় জঙ্গলের মধ্যে রাম-সীতা বিগ্রহ স্থাপন করে সাধনায় রত হন গোপাল দাস বাবাজী । এই মহান বৈষ্ণব সাধকের কথা শোনার পর ১১৫২ বঙ্গাব্দে সেখানে রাম-সীতা ও রঘুনাথ জিউর মন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য ৬৯বিঘা জমি দান করেন বর্ধমানের মহারাজা তিলকচন্দ্র মহতাব । এছাড়া বাবাজির সাধনস্থলে একটা পুকুর খনন করে দেন বীরভূমের পাকুরহাঁস গ্রামের এক ব্যক্তি । কিন্তু দধিয়া বৈরাগ্য তলায় মেলার শুরুর বিষয়ে সঠিক সময় জানা যায়না । তবে আজও দধিয়া বৈরাগ্য তলায় ঐতিহ্যবাহী মেলা নিয়ে আজও মানুষের মধ্যে উন্মাদনা কাজ করে ।।