মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী,জহরলাল নেহেরুর খ্রিস্টান ও ইসলাম প্রীতি, বামপন্থী ইতিহাসবিদদের তথাকথিত ‘সেকুলারিজম’-এর কারনে ভারতের মহান হিন্দু বীরেরা আজও ইতিহাদের পাতায় উপেক্ষিত হয়ে আছেন । আর ভারতীয় বীরদের অদুরদর্শি ও দুর্বল প্রমান করার কাজ সুনিপুণভাবে করে গেছেন স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ । ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখার কথা উঠলেই ওই সমস্ত কথিত “মহান” চরিত্রগুলির আসল স্বরূপ উন্মোচনের আশঙ্কায় এক শ্রেণীর মানুষ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে ।
স্বাধীন ভারতের ইতিহাসকারদের কুকীর্তির অন্যতম নজির হল মহান রাজা পুরুষোত্তম বা পুরুর (দ্য গ্রেট পোরাস) সাথে আলেকজান্ডারের যুদ্ধ কাহিনী । ভারতীয় তথাকথিত সেকুলার ইতিহাসকাররা লিখে গেছেন যে আলেকজান্ডারের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন পৌরবের রাজা ‘দ্য গ্রেট পোরাস’ । কিন্তু আদপেই কি এটা সত্যি ছিল ? কে পরাজিত হয়েছিলেন- মহান পুররাজা নাকি গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার ? ভারতের কথিত সেকুলার ইতিসকাররা বিকৃত ইতিহাস লিখে নিজের দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে গেলেও গ্রীক চলচ্চিত্র নির্মাতা অলিভার স্টোন একটি চলচ্চিত্র বানিয়ে ‘আলেকজান্ডারের পরাজয়’ মেনে নিয়েছেন । ভারতের ইতিহাসকারদের আর একটি মিথ্যাচার হল আলেকজান্ডারকে বিশ্ববিজয়ী বানানো । কারন মহারাজা পুরুর রাজত্ব ছাড়াও ভারতে এরকম অনেক রাজ্য ছিল । ‘আলেকজান্ডার’ যদি ‘মহান পোরাস’কে পরাজিতও করে তবে কীভাবে তিনি ‘বিশ্বজয়ী’ হলেন…? পোরাসের বিরুদ্ধে আলেকজান্ডারের বিজয়কে ভারতের বিজয় বলা যায় না এবং ভারতকে বাদ দিয়ে এশিয়ার ‘চীন’, ‘জাপান’-এর মতো দেশগুলিও জয় করা বাকি ছিল আলেকজান্ডারের । তাহলে তিনি কী করে তাকে বিশ্ব বিজেতা উপাধিতে ভূষিত করল ভারতের ইতিহাসবিদরা ?
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর(৩২৭-৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজা পুরুষোত্তম বা পুরু ছিলেন পৌরবের রাজা । প্রাচীন ভারতীয় রাজ্য ঝিলাম বা বিতস্তা ও চেনাব বা চন্দ্রভাগা নদীদ্বয়ের মধ্যে অবস্থিত ছিল ‘মহান পোরাস’ এর রাজ্য । যা আধুনিক পাঞ্জাব, পাকিস্তান এবং বিপাশা নদীর অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত । একজন মহান ‘কৌশলবিদ’, ‘দূরদর্শী’, শক্তিশালী’, ‘সাহসী’, ‘বিজয়ী’ রাজা ছিলেন পুরু । ঝিলম নদীর চারপাশে ছিল ‘রাজা আম্বীর’ রাজত্ব । পোরাসের সাথে আম্বীর পুরানো শত্রুতা ছিল, তাই আলেকজান্ডারের আগমনে অম্ভি খুশি হয়েছিলেন এবং এটিকে তার শত্রুতা প্রকাশের উপযুক্ত সুযোগ বলে মনে করেছিলেন। ‘অভিসার’-এর লোকেরা নিরপেক্ষ রইল। পোরাস একাই আলেকজান্ডার ও আম্বীর সম্মিলিত সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হন।
গ্রীক দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ‘প্লুটার্ক’ অনুসারে আলেকজান্ডারের বিশ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং পনের হাজার ঘোড়া সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পোরাসের সংগ্রহ করা সৈন্যের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ‘পারস্য সৈন্য’ও আলেকজান্ডারকে সাহায্য করেছিল। প্রসঙ্গত, পার্সিয়ান দেশের কিছু অংশ ইয়াবনদের দ্বারা লুণ্ঠিত ও ধ্বংস হয়েছিল; পরবর্তী সময়ে এটি পারস্য নামে পরিচিত হয়েছিল।
এই যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই ‘মহান পোরাস’ ‘মহাবিনাশ চালাতে শুরু করেন । ‘গ্রেট পোরাস’-এর সৈন্য ও হাতিদের দ্বারা সৃষ্ট ধ্বংসলীলা “বিশ্বজয়ী” আলেকজান্ডার ও তার সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে । ‘কার্টিয়াস’ গ্রীক সৈন্যদের মধ্যে পোরাসের হাতিদের দ্বারা সৃষ্ট ত্রাসের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘বৃংহিতর শব্দে তৈরি ভয়ানক আর্তনাদ আলেকজান্ডারের ঘোড়াগুলোকে শুধু আতঙ্কিতই করেনি, যার ফলে তারা বিচলিত হয়ে রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে । পুরুর সেনার বিশালাকৃতির হাতির গর্জনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে আলেকজান্ডারের অশ্বারোহীরা । এদিকে হাতিরা গ্রীক সম্প্রাটের সেনাদের পদদলিত করে ও শুঁড় দিয়ে আছড়ে মারতে শুরু করে । ফাইল আলেকজান্ডারের সেনার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক আতঙ্ক । তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালাতে শুরু করে ।
পুরু সেনার হাতিগুলো বহু মানুষকে তাদের পায়ের নিচে পিষে মেরে ফেলেছিল এবং সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যটি ছিল যখন এই বড় হাতি তার শুঁড় দিয়ে একজন ‘গ্রীক সৈনিক’ (যবন সৈনিক) কে ধরে মাথার উপরে ঘুরিয়ে মাটিতে আছরে হত্যা করেছিল। এই প্রাণীগুলো দারুণ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। ‘ডিওডেরাস’ দ্বারাও অনুরূপ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, দৈত্যাকার হাতিদের প্রচুর শক্তি ছিল এবং তারা অত্যন্ত উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছিল। পায়ের তলায় বহু সৈন্যের হাড় ও পাঁজর ভেঙ্গে ফেলে। হাতিরা তাদের শুঁড় দিয়ে শক্ত করে ধরে যবন সৈন্যদের ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিচ্ছিল । এছাড়া হাতিগুলি বিশাল দাঁত সৈন্যদের পেটে আমূল বসিয়ে দিচ্ছিল ।
ইএ ডব্লিউ ব্যাজের বর্ণনা অনুযায়ী, ‘ঝিলমের যুদ্ধে আলেকজান্ডারের অধিকাংশ অশ্বারোহী নিহত হয়।’
আলেকজান্ডার বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি যদি এখন যুদ্ধ চালিয়ে যান তবে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করবেন। তাই আলেকজান্ডার পোরাসের কাছে শান্তি প্রার্থনা করলেন, ‘স্যার পোরাস, আমি আপনার সাহসিকতা ও শক্তি মেনে নিয়েছি। আমি চাই না আমার সব সৈন্য মারা যাক। আমি তাদের অপরাধী।’
ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে, পোরাস আত্মসমর্পণকারী শত্রুকে হত্যা করেননি। যদিও এসব কথা কোনো ভারতীয় বলেনি, একজন বিদেশি বলেছেন।
এরপর পোরাস আলেকজান্ডারকে উত্তরের পথ দিয়ে যেতে দেননি। আলেকজান্ডারকে সেই ‘ভয়ঙ্কর উপজাতি’ অধ্যুষিত পথ দিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, যে পথ দিয়ে আলেকজান্ডার এতটাই আহত হন যে শেষ পর্যন্ত তাকে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছিল। এই বিষয়ে ‘প্লুটার্ক’ লিখেছেন যে ‘মালাউই’ নামক ‘ভারতীয় গোত্র’ খুবই হিংস্র ছিল।
এর মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়, আলেকজান্ডার এতটাই আহত হন যে শেষ পর্যন্ত তাকে তার জীবন বিসর্জন দিতে হয়। আসলে আলেকজান্ডার আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। পোরাস তার লুট করা সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে । তাকে এবং তার সৈন্যদের খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল। কিন্তু অবশিষ্ট গ্রীক সৈন্যরা খালি হাতে ফিরতে চায়নি । তারা এজন্য আলেকজান্ডারকে দোষী মনে করে এবং গ্রীসে পৌঁছানোর আগেই তাকে হত্যা করে।।