এইদিন ওয়েবডেস্ক,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),০৬ সেপ্টেম্বর : ভারত সরকারের ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এর অনুকরণে ‘মিশন নির্মল বাংলা’ প্রকল্প চালু করেছে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ২০২১ সালে শুরু হয় এই ‘মিশন নির্মল বাংলা’। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত এই কর্মসূচি আদপেই কি বাস্তবায়ন হচ্ছে ? পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার বাজারের সড়কপথের দু’পাশের চিত্র দেখলে বাংলাকে নির্মল করার বিষয়ে শাসকদল ও প্রশাসনের কতটা সদিচ্ছা আছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এবং উঠছেও । কোথাও ভাতার বাজার সংলগ্ন ঘন জনবসতি এলাকায় সড়কপথের ফুটপাত আস্তাকুড় (ডাম্পিং গ্রাউন্ড) হিসাবে ব্যবহার করছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা । কখনো তারা বর্জ্য ফেলার জন্য বেছে নিচ্ছেন ভাতার বাজারের অদূরে বর্ধমান-কাটোয়া রাজ্য সড়কপথের দু’পাশ । আর চলতি বর্ষায় সেই আবর্জনা পচে সৃষ্ট দুষণে চুড়ান্ত নাকাল হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা ৷ বাড়ছে মশা-মাছির উপদ্রব । অথচ প্রায় দেড়বছর আগেই সরকারি অনুদানে এলাকায় নির্মিত হয়েছে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প । তিনটি বর্জ্যবাহী টোটো পর্যন্ত কেনা হয় বলে খবর । স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ যে শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দের কারনে ভাতার বাজারের ‘মিশন নির্মল বাংলা’ আজ অথৈ জলে ।
প্রসঙ্গত,ভাতার বাজারের ব্যবসায়ীদের পরিত্যক্ত সামগ্রী ফেলার সমস্যা দীর্ঘদিনের । কারন এলাকায় কোনো আস্তাকুড় নির্মান করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি তৎকালীন সিপিএম সরকার৷ সেই সময় ভাতার বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনের আশপাশ এলাকা মূলত আস্তাকুড় হিসাবে ব্যবহার করতেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা । তৃণমূলের ১৪ বছরের শাসনকালেও সেই ব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি । ভাতার থানার উলটো দিকে কৃষি মান্ডি নির্মান করে শব্জি ও মাছ ব্যবসায়ীদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও ব্যবসায়ীদের পরিত্যক্ত সামগ্রী ফেলার জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থান নির্ধারিত করা হয়নি ।
জানা গেছে,ভাতারের কুলনগর গ্রামের কাছে ভাতার মালডাঙ্গা সড়কপথের ধারে বিগত ২০২৩-২৪ আর্থিক বর্ষে ২ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা খরচ করে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প চালু হয়। নিয়ম অনুযায়ী ওই প্রকল্পের জায়গায় এলাকার যাবতীয় আবর্জনা জড়ো করে পচনশীল এবং অপচনশীল বর্জ্য পৃথকীকরণ করার কথা। সরকারিভাবে গ্রামপঞ্চায়েতের মাধ্যমে বাজার এলাকায় আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট পাত্র দেওয়া হয়েছে। শোনা যায় যে বর্জ্য বহনের জন্য ৩টি মালবাহী টোটো পর্যন্ত কেনা হয়েছিল । স্থানীয় এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার খামারে টোটোগুলিকে দীর্ঘদিন ধরে রোদে-জলে পড়ে থাকতে দেখা যায়৷ যদিও সেগুলি এখন আর নজরে পড়ে না । স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের কারনে ভাতার বাজারে ‘মিশন নির্মল বাংলা’ প্রকল্প চালু করা সম্ভব হয়নি ।
বর্ধমান (উত্তর) মহকুমাশাসক তীর্থঙ্কর বিশ্বাস বলেন, ‘সরকারিভাবে নির্দেশ আছে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে আবর্জনা ফেলা হবে। সেখানে দুধরনের বর্জ্য পৃথকীকরণ করা হবে। এলাকাকে নির্মল রাখতে হবে।’ তিনি দাবি করেছেন,’ভাতার পঞ্চায়েত এলাকার ওই বিষয়টি নিয়ে এখনও পর্যন্ত আমার কাছে অভিযোগ আসেনি। তবে বিডিওর মাধ্যমে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তবে মহকুমাশাসক যাইই দাবি করুন না কেন, স্থানীয় বাসিন্দারা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে একাধিকবার পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের জানানো হয়েছে। দুবার বিডিও অফিসে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনবসতি এলাকায় খোলা জায়গায় আবর্জনা ফেলা আজ অব্দি বন্ধ হয়নি।
জানা গেছে,ভাতার বাজারের কামারপাড়া মোড় ও কৃষি মান্ডির ব্যবসায়ীরা ভাতার-কামারপাড়া সড়কপথের ঠিক পাশে পূর্ত দফতরের মালিকানাধীন ‘ সাহাদিঘি ‘ নামে একটি জলাশয়ের পাড়টাকেই আস্তাকুড় হিসাবে বেছে নিয়েছে । ওই এলাকার আশেপাশেই রয়েছে ঘন জনবসতিপূর্ণ সুকান্তপল্লি এলাকা । এদিকে বর্ষার বৃষ্টির জলে সেই সমস্ত বর্জ্য পচে ব্যাপক দুষণ ছড়াচ্ছে । ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে মশা-মাছির উৎপাত । পাশাপাশি সুকান্তপল্লি এলাকার ভিতর দিয়ে যাওয়া ক্যানেলটিরও দীর্ঘ দিন সংস্কার না হওয়ায় সেটি মজে গিয়ে দুষণ প্রবল আকার ধারন করেছে৷
স্থানীয় বাসিন্দা লক্ষণচন্দ্র মাহান্ত বলেন,’আমাদের পাড়ার মধ্যে সবজিবাজার থেকে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের যাবতীয় আবর্জনা ফেলা হয়। কোথাও কোনও পশু মারা গেলে এখানে দেহ নিয়ে এসে ফেলা হচ্ছে। প্রচণ্ড দূষণ ছড়াচ্ছে। আবর্জনা উড়ে এসে সড়কপথে পড়ছে। বৃষ্টি হলে নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।’ গৃহবধূ শম্পা মাহান্ত বলেন,’আমরা পাড়া থেকে দুবার বিডিও অফিসে লিখিতভাবে আবেদন করেছি যাতে এভাবে জনবসতি এলাকায় আবর্জনা ফেলা বন্ধ হয়। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি।’
এদিকে ভাতার বাজারের ব্যবসায়ী সুচাঁদ দাস, বাসুদেব ভট্টাচার্যরা বলেছেন,’আমাদের মার্কেটের পাশে পঞ্চায়েত থেকে দুটি ড্রাম দিয়ে যাওয়া হয়েছে আবর্জনা ফেলার জন্য। আমরা সেখানেই আবর্জনা ফেলি। কিছুদিন পঞ্চায়েত থেকে আবর্জনা তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। গত একমাস ধরে আর পঞ্চায়েত থেকে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে আমরা নিজেদের খরচেই পরিষ্কার করছি।’
কিন্তু পঞ্চায়েত ও প্রশাসনের “কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প” কার্যকরী করার বিষয়ে এত অনীহা কেন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাতার বাজারের এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘এর পিছনে কারন হল তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব । কিছুদিন আগেও এক গোষ্ঠীর নেতার খামারে প্রকল্পের জন্য কেনা আবর্জনা বহনের জন্য তিনটে টোটো দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেছে । রোদে জলে পড়ে থেকে সেগুলো নষ্ট হচ্ছিল । ওদিকে কুলনগর গ্রামের কাছে দিঘির পাশে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের জন্য একটা পাকা ছাউনিও নির্মান হয়েছে । সেটা কোনো কাজেই আসছে না । এদিকে দুষণে জেরবার হতে হচ্ছে আমাদের ।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ভাতার গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রূপালী ঘোষ বলেন,’আমাদের পঞ্চায়েতের কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কিছু কাজ বাকি রয়েছে। পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে সুকান্ত পল্লীর ওই জায়গা থেকে আবর্জনা তুলে পরিষ্কার করে দেওয়া হবে।’ তবে কি কাজ বাকি আছে সেটা তিনি খোলসা করেননি ।।