শ্যামসুন্দর ঘোষ,মন্তেশ্বর(পূর্ব বর্ধমান),২৪ আগস্ট : মঙ্গলবার পরিসমাপ্তি হল পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার করন্দা গ্রামের বাস্তুদেবী কন্দেশ্বরীর পূজো । চার দিনের এই পূজোয় গোটা গ্রাম মেতে ওঠে । তবে করোনা পরিস্থিতির কারনে বিগত দু’বছর ধরে কন্দেশ্বরীর পূজোতে প্রভাব পড়েছে । নিয়ম মেনে পূজো হলেও জাকজমক অনেকাংশে কম । তবু এই পরিস্থিতির মাঝেও দেবী কন্দেশ্বরীর পূজো ঘিরে উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা গেল মন্তেশ্বর ব্লকের পিপলন অঞ্চলের করন্দা গ্রামে ।
কষ্টি পাথরের তৈরি দেবী কন্দেশ্বরী আসলে মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি । প্রায় ৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দেবীমূর্তিটির ওজন প্রায় এক ক্যুইন্টাল । দেবী দন্ডায়মান । মাথায় কিরীট মুকুট । দেবীর অঙ্গে অলঙ্কার । বাম হাতে মহিষাসুরের চুলের মুঠি ধরা । দেবীর ডান হাতের শূল বিদ্ধ করেছে মহিষাসুরকে । বাকি আট হাতে বিভিন্ন অস্ত্রসস্ত্র । মূল দেবী মূর্তির দু’পাশে অসি হাতে ডাকিনী ও যোগিনীর মূর্তি । দেবীর পায়ের কাছে পড়ে মুন্ডকাটা মহিষ । গ্রামবাসীরা জানান,দেবী কন্দেশ্বরীর মূর্তির আদল অনেকটা মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রাম সতিপীঠের যোগাদ্যা মূর্তির মতই । পার্থক্য শুধু যোগাদ্যা মূর্তির বাম দিকে সিংহ থাকে । তবে দেবী কন্দেশ্বরী মূর্তির ডান দিকে থাকে দেবীর বাহন সিংহ ।
করন্দা গ্রামে কন্দেশ্বরী দেবীর পূজোর সূচনার পিছনে এক প্রাচীন কাহিনী প্রচলিত আছে । সেবাইত বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায়, রাজীব মুখোপাধ্যায়রা জানিয়েছেন, প্রায় আট’শ বছর আগে কালাপাহাড়ের সময়ে মূর্তিটি উদ্ধার হয় করন্দা গ্রামেরই বামুন পুকুর নামে একটি পুকুর থেকে । জেলেরা পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন । সেই সময় জালের সঙ্গে উঠে আসে কষ্টি পাথরের ওই সিংহবাহিনী মূর্তিটি । তাঁরা বলেন, ‘তারপর প্রতি বছর শ্রাবন মাসের শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে অর্থাৎ ঝুলন পূর্ণীমার আগের দিনে দেবীর পূজো হয়ে আসছে । আমাদের পূর্ব পুরুষরা প্রথমে পূজোর সূচনা করেছিলেন । পরে গ্রামের সামন্ত ও মণ্ডল পরিবার গ্রামের মাইচতলায় একটি মন্দির তৈরি করে দেন । কন্দেশ্বরী দেবীর নিত্যসেবা ও বাৎসরিক পূজোর জন্য বর্ধমানের মহারাজা বেশ কিছু জমি ও পুকুর দান করেছিলেন।’
সেবাইতরা জানান, দূর্গার ধ্যানমন্ত্রে পূজো হয় কন্দেশ্বরী দেবীর । চট্টোপাধ্যায় ও বন্দ্যোপাধ্যায়রা ৬ মাস করে পালা করে দেবীর নিত্যসেবা চালান । বাৎসরিক পূজোর প্রথম দিন বামুন পুকুরের ঘাটে প্রথমে গ্রামের হাড়ি পাড়ার বাসিন্দাদের পূজো হয় । এই পূজো ঘাট পূজো হিসাবে পরিচিত । ঘাটে শূয়োর বলির প্রথা রয়েছে । তারপর দেবীকে চাঁদোয়ার আড়াল দিয়ে গ্রামের বাঁশতলার মন্দিরে নিয়ে আসেন সামন্ত ও মণ্ডল পরিবারের সদস্যরা । চার দিন ধরে পূজো চলে । দোলায় চাপিয়ে গ্রামের দূয়ারে দূয়ারে দেবীকে ঘোরানো হয় । সেখানে পূজো ও ছাগবলিও হয় । কন্দেশ্বরী দেবীর পূজোতে এক হাজারের অধিক ছাগ ও শুয়োর বলিদান হয় বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা । পূজোর শেষের দিন দেবীকে পঞ্চগব্য করে মূল মন্দিরে আনা হয় ।
কন্দেশ্বরী দেবীর পূজোয় গ্রামের সমস্ত বর্ণের মানুষ সমানভাবে অংশগ্রহন করেন । এই পূজো ঘিরে করন্দা গ্রামের প্রতিটি পরিবারের আত্মীয়স্বজনরা এসে জড়ো হয় । মেলা বসে । প্রায় আট’শ বছরের প্রাচীন এই পূজো ঘিরে অকাল শারদোৎসবে মেতে ওঠেন আপামর গ্রামবাসী ।।