শ্যামসুন্দর ঘোষ,মন্তেশ্বর(পূর্ব বর্ধমান),১৫ সেপ্টেম্বর : শতাব্দী প্রাচীন মনসার ঝাপান (পূজো) ঘিরে উৎসবের আবহ পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বরের খান্দড়া ও বামুনিয়া গ্রামে । বসেছে মেলা । ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন । মন্তেশ্বরের পিপলন পঞ্চায়েত এলাকার এই দুই গ্রামের দু’দিনের মনসা পূজো ঘিরে মেতে উঠেছে গোটা এলাকা । স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে,খান্দড়া গ্রামের গ্রাম্য দেবী মনসা মূর্তিটি কষ্টিপাথরের তৈরি । এক সময়ে এলাকার জমিদার সরকার পরিবারের কূলদেবী ছিলেন এই মা মনসা । দুই শতাধিক বছর আগে এলাকা ছাড়া হয়ে যায় সরকার পরিবার ৷ পড়ে থাকে তাঁদের বসত বাড়ি ও কূলদেবী । কালক্রমে জমিদার বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও গ্রামবাসীরা সযত্নে রেখে দেয় তাঁদের কূলদেবীকে । নিয়মমত পূজো হত । কিন্তু তখন মনসা পূজো ততটা ব্যাপকতা পায়নি । খান্দড়া গ্রামের মনসা পূজো ঘিরে সার্বজনীন উৎসব শুরু হয় প্রায় ১২০ বছর আগে ।
গ্রামবাসী সুজিত গাঙ্গুলী বলেন, ‘আমাদের গ্রামে মা মনসার ঝাপান শুরু হওয়ার পিছনে একটি কাহিনী আছে । শুনেছি, ১২০ বছর আগে এই দিনে পাশের মধ্যমগ্রামে মনসার ঝাপান দেখতে যাচ্ছিলেন খান্দড়া গ্রামের কয়েকজন গ্রামবাসী । সেই সময় নজরে পড়ে যায় আমার দাদু আশু গাঙ্গুলীর । আমার দাদু তখনকার দিনে এলাকার একমাত্র ম্যাট্রিকুলেশন পাশ ব্যক্তি ছিলেন ৷ তাই দাদুকে সবাই মেনে চলতেন । ওই গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ঝাপান দেখতে যাওয়ার কথা শুনে দাদুর খারাপ লাগে । কারন মধ্যমগ্রাম অনেকটাই দূরে । তিনি গ্রামবাসীদের আশ্বস্ত করে জানান, এবার থেকে আমাদের গ্রামেই মনসার ঝাপান শুরু হবে । হয়েছিলও তাই । তারপর থেকে মধ্যমগ্রামের ঝাপান শেষ হলেই আমাদের গ্রামে ঝাপান হত। সেই প্রথা আজও চলে আসছে ।’
স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে,প্রতিবছর ২৮ ও ২৯ ভাদ্র খান্দড়া গ্রামে মনসার পূজো হয় । একই দিনে মনসা পূজো হয় পাশের বামুনিয়া গ্রামেও । পূজোর শুরুর দিকে মনসা মূর্তি বামুনিয়া গ্রামে নিয়ে যাওয়া হত । কিন্তু ৪০-৫০ বছর আগে মূর্তি নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে । অনেকে আহতও হন । তারপর থেকে সেখানে মূর্তি নিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় । তবু প্রাচীন প্রথা মেনে খান্দড়া গ্রামের সঙ্গে একই দিনে মনসা পূজোয় মেতে ওঠেন বামুনিয়া গ্রামবাসীরাও । এদিকে জমিদার বাড়ি ধুলিস্যাৎ হয়ে যাওয়া এতদিন খান্দড়া গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় একটি মাটির ঘরে দেবীকে রেখে নিত্যসেবার পূজো করা হত । বছর ত্রিশ আগে একই জায়গায় একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী নামে গ্রামের এক হাইস্কুল শিক্ষক ।
দেবীর সেবাইত সুখেন মুখোপাধ্যায়,দীপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, ‘পূজোর দু’দিন দেবীকে গোটা গ্রাম ঘোরানো প্রথা । সেই প্রথা মেনে প্রতিটি পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে ঘোরানো হয় দেবীকে । রয়েছে বলিদান প্রথা । পুজোর দু’দিন ৪০০-৫০০ মেষ, ছাগল, শুকর ও হাঁস বলি হয় । পূজোর শেষ দিনে দেবীকে পঞ্চগব্য করে মূল মন্দিরে এনে রাখা হয় । আজ বুধবার দেবীকে মূল মন্দিরে এনে তোলা হবে ।’
জানা গেছে,মনসার ঝাপান ঘিরে নিঙার পাড়ের ফুটবল মাঠে,খান্দড়ার পাশে মেমারি- মালডাঙ্গা সড়ক পথের ধারে ও বামুনিয়া গ্রামসহ একাধিক জায়গায় মেলা বসেছে । প্রতিটি বাড়িতে এসেছে প্রচুর আত্মীয়স্বজন । প্রতিটি পাড়ার বাসিন্দারা তাঁদের নিজেদের মত করে গানবাজনার আয়োজন করেছে । খান্দড়া গ্রামের মনসার ঝাপান ঘিরে কার্যত সরগরম গোটা এলাকা ।।