জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বর্ধমান,১০ জানুয়ারী : সমাজ মাধ্যম বা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের দৌলতে বাংলার অগণিত মানুষ এক অসাধারণ দৃশ্যের সাক্ষী থাকার সুযোগ পেল। দৃশ্যটি একইসঙ্গে কৌতুকের ও শিক্ষা জগতের পক্ষে বড়ই লজ্জার। দুই প্রবীণ ব্যক্তির হাতাহাতি নিঃসন্দেহে কৌতুকের এবং যেহেতু তারা শিক্ষক তাই একইসঙ্গে লজ্জার। এমনিতেই নিয়োগ সংক্রান্ত দূর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা এবং উদ্ভট নির্দেশাবলী নিয়ে শিক্ষা দপ্তর নাজেহাল ও শিক্ষকমহল বিভ্রান্ত , তার উপর এই অবাঞ্ছিত ঘটনা আর এক দফা সমস্যার সৃষ্টি করবে।
প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, যদিও ভিডিওর সত্যতা এই প্রতিবেদক যাচাই করে দেখেনি, দুই প্রবীণ ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে মারপিট করছে। এ্যাকশন সিনেমার স্টাইলে পরস্পরকে ঘুষি মারছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাশে থাকা কয়েকজন এগিয়ে আসেন, যেমন পাড়ার ঝামেলায় অথবা সিনেমায় হয় আর কি! পরে জানা যায় মারপিটে লিপ্ত ওরা দু’জন নদীয়ার একটি সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অপরজন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ভূগোলের সহকারী শিক্ষক।
জানা যাচ্ছে ভূগোল শিক্ষক তার প্রাপ্য কোনো একটি জিনিস চাইলে প্রধান শিক্ষক দিতে অস্বীকার করেন। সেই বিষয়কে কেন্দ্র করেই নাকি এই অবাঞ্ছিত ঝামেলার সৃষ্টি। যদিও প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে অথবা সহকারি শিক্ষকদের মধ্যে ঝামেলার ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও অনেকবার শোনা গেছে বা সমাজ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের ‘পোস্ট’ দেখা গেছে এবং মনে হচ্ছে ‘উৎসশ্রী’-র সৌজন্যে ভবিষ্যতে আরও এইরকম ঘটনা দেখা যাবে ।
২০২০ সালের সরস্বতী পুজোর সময় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজ নিজ জেলায় শিক্ষকদের বদলির ব্যাপারে ঘোষণা করেন। দূর দূরান্তের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সরকারি নির্দেশ মেনে বদলির আশায় বিকাশ ভবনে বদলি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে আসেন। অথচ এটা নিজ নিজ জেলার ডি.আই অফিসে করা যেতে পারত। কাগজপত্র জমা দিলেও বদলি হলো খুব কম সংখ্যক শিক্ষকের। সেখানেও নাকি লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষোভ প্রশমনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে টালবাহানার পর অবশেষে গত বছর আগষ্ট মাসে বদলির জন্য চালু হয় ‘উৎসশ্রী’ প্রকল্প।
যেহেতু অনলাইন, তাই আবার আশার আলো দেখলেন দূরবর্তী জেলার শিক্ষক শিক্ষিকারা। বদলি হলো প্রচুর। কিন্তু আইনের বেড়াজালে প্রকৃত দূরবর্তী জেলার অনেক শিক্ষক শিক্ষিকারা আটকে গেলেন। মাত্র তিরিশ কিলোমিটার দূরের শিক্ষক বদলি পেলেও তিনশ কিলোমিটার দূরের শিক্ষক বদলি পেলেন না। সংখ্যাটা তুলনামূলকভাবে কম হলেও সমস্যা সেই তিমিরেই থাকল। সম্ভবত বাস্তবের সঙ্গে যোগাযোগহীন শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদের জন্য এই সমস্যা। দূরত্বকে বেশি গুরুত্ব দিলে হয়তো সমস্যা অনেক কম হতো। শুধু তাই নয় একদল প্রধান শিক্ষক কর্তৃক সরকারি নির্দেশের ভুল ব্যাখ্যাও সমস্যা সৃষ্টির কারণ। সরকারি নির্দেশ বাংলা পরিভাষায় দিলে ভাল হতো ।
এরপর এলো ‘সিঙ্গেল’ টিচারের গল্প। নিয়োগ পত্রে সিঙ্গেল টিচার লেখা না থাকলেও এই অজুহাতে অনেকেই আটকে গেলেন। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রায় প্রতিটি বিষয়ের এবং মাধ্যমিক স্তরের কয়েকটি বিষয়ের শিক্ষকরা সিঙ্গেল। সেই হিসেবে তারা তো কোনো দিনই বদলি পাবেননা। সমাজ মাধ্যমে অনেকেই ঠাট্টা করে পোস্ট করেছে – সিঙ্গেলের অজুহাতে তারা হয়তো অবসর নিতেও পাবেন না। নিয়োগ কর্তাদের ব্যর্থতা তাদের যে কতদিন সহ্য করতে হবে কে জানে !
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও পরের ঝামেলা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিয়ে। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালন সমিতির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আসছে। ইতিমধ্যে আদালতের রায়ে অনেকেই শাস্তির মুখে পড়েছেন। সেই সংখ্যাটা আগামী দিনে আরও বাড়তে পারে। শুধু প্রধান শিক্ষক নয় কয়েকজন ডি.আই একই শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন। জনৈক প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালত যে মন্তব্য করেছে তাতে প্রধান শিক্ষকের পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া কতটা সম্মানজনক হবে সেটা ভাববার বিষয়। যদিও আদালতের রায় নিয়ে কিছু বলা যায়না, তবুও মনে হচ্ছে আর্থিক জরিমানার সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে মামলাকারীর খরচটা আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হতো এবং তার পদাবনতি সহ দূরে বদলির ব্যবস্থা করা হতো তাহলে হয়তো যোগ্য শিক্ষকদের সমস্যা হতো না ।
যারা মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে বদলির আবেদন করছেন তাদের আবার আর এক সমস্যা। তিনি যে জেলার বাসিন্দা সেই জেলার বি.এম.ও.এইচ বা সি.এম.ও.এইচ এর সার্টিফিকেট হলে হবেনা, শিক্ষক যে জেলায় কর্মরত সেই জেলার মেডিক্যাল আধিকারিকদের নাকি সার্টিফিকেট লাগবে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে তার অসুস্থ স্ত্রীকে নিজের কর্মরত জেলায় নিয়ে যেতে হবে। এতো মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। যিনি সার্টিফিকেট দিচ্ছেন তিনি সরকারি রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত ডাক্তার। যদি সন্দেহ হয় তাহলে স্হানীয় মেডিক্যাল আধিকারিকদের সার্টিফিকেট নেওয়া যেতেই পারে। এখন তো শোনা যাচ্ছে অনেক মেডিক্যাল আধিকারিক নাকি টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট দিচ্ছে। একই অভিযোগ প্রধান শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও আসছে। এরাই মনে হচ্ছে বদলি সংক্রান্ত সরকারি প্রচেষ্টাকে জলাঞ্জলি দেবে।
এটা ঠিকই বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস নাহলে বা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের ফল খারাপ হলে সমস্ত চাপটা প্রধান শিক্ষকের উপরেই পড়ে। আবার এটাও ঠিক ছেলেমেয়েদের স্বার্থে আপার প্রাইমারি স্তরের উচ্চ ডিগ্রীধারী কর্মশিক্ষা, সংস্কৃত ও শারীরশিক্ষার সিঙ্গেল টিচাররা নিয়মিত উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ক্লাস নেন। সুতরাং তাদের বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
যেকোনো প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গেলে প্রতিষ্ঠানের ‘হেড’ কে অনেক চাপ সহ্য করতে হয়। সহকর্মীদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে হয়। কিন্তু শিক্ষক বদলিকে কেন্দ্র করে যেভাবে একশ্রেণির প্রধান শিক্ষকদের আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে তাতে কিন্তু শিক্ষক সমাজের সম্মান খুব একটা বাড়ছেনা। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতেই হবে ।।