এইদিন ওয়েবডেস্ক,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),০৬ এপ্রিল : ২০১৬ বিধানসভায় তৃতীয় স্থান । তার ঠিক তিন বছর পর ২০১৯ লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে এক লাফে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা বিজেপি আগামী বিধানসভা ভোটে বর্ধমান-দূর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ভাতারে শাসকদলকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে চলেছে । একদিকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া অন্যদিকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের কতটা গুছিয়ে নিতে পারে সেটাই দেখার । তবে যাই হোক না কেন ২১-শের নির্বাচনে ভাতার বিধানসভায় বিজেপি-তৃণমূল লড়াই যে উপভোগ্য হতে চলেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত রাজনৈতিক মহল ।
পূর্ব বর্ধমান জেলার ১৬ টি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটগ্রহন হবে দুই পর্যায়ে । ১৭ এপ্রিল প্রথম পর্যায়ে ও ২২ এপ্রিল দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোট গ্রহন হবে । ভাতার বিধানসভায় ভোট হবে দ্বিতীয় পর্যায়ে । ইতিমধ্যে পূর্ব বর্ধমানের সমস্ত আসনেই প্রার্থীর নাম ঘোষনা করে দিয়েছে বিজেপি,তৃনমূল ও সংযুক্ত মোর্চা । ভাতার বিধানসভায় মহেন্দ্রনাথ কোঁয়ারকে টিকিট দিয়েছে বিজেপি । ভাতার থানার কুলচন্ডা গ্রামের বাসিন্দা বছর ৩৫-এর মহেন্দ্রনাথের ইমারতি সামগ্রীর পারিবারিক ব্যাবসা রয়েছে । তৃণমূলের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ভাতার থানার এরুয়ার গ্রামের বাসিন্দা তৃণমূল শাসিত ভাতার পঞ্চায়েত সমিতির ভূমি কর্মাধ্যক্ষ মানগোবিন্দ অধিকারী । অন্যদিকে সংযুক্ত মোর্চার তরফ থেকে সিপিএমের প্রার্থী হলেন ভাতার থানার বামশোর গ্রামের বাসিন্দা নজরুল হক ।
তিন প্রার্থীই দাবি করেছেন জয়ের বিষয়ে তাঁরা একশ শতাংশ নিশ্চিত । তৃণমূল প্রার্থী মানগোবিন্দ অধিকারী বলেন, ‘বিগত দশ বছরে ভাতারে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে । এছাড়া এলাকায় আমার নিজস্ব একটা পরিচিতি আছে । ভাতার পঞ্চায়েত সমিতিতে ৫ বছর আমি পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ ছিলাম । তারপর ভূমি কর্মাধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করেছি । সারা বছর আমি মানুষের দায়ে বিপদে পাশে থাকি । তাই জেতার বিষয়ে আমি একশ শতাংশ নিশ্চিত ।’
একই দাবি করেছেন সিপিএমের প্রার্থী নজরুল হক । তিনি বলেন, ‘আমি এলাকার বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রচার করছি । মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি মানুষ তৃণমূল ও বিজেপি এই দুই দলের উপরেই বীতশ্রদ্ধ । কারন তৃণমূল দলটাই এখন বিজেপিতে কনভার্ট হয়ে গেছে । আবার বিজেপি থেকেও তৃণমূলে আসছে । তৃণমূল-বিজেপির এই গোপন বোঝাপড়া মানুষ ধরে ফেলেছে । তাই জয়ের বিষয়ে আমি একশ শতাংশ নিশ্চিত ।’ অন্যদিকে বিজেপি প্রার্থী মহেন্দ্রনাথ কোঁয়ারের কথায়, ‘প্রচার করতে গিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা দেখছি তাতে জয়ের বিষয়ে আমি একশ দশ শতাংশ নিশ্চিত ।’
প্রসঙ্গত,২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে সারা রাজ্যের পাশাপাশি ভাতারেও পালাবদল হয় । খুব অল্প ব্যাবধানে জিতে যান তৎকালীন তৃণমূল প্রার্থী । পরবর্তী ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত ভাতারে লড়াইটা ছিল মূলত সিপিএম ও তৃণমূলের মধ্যে । তখন প্রায় ৬ হাজার ভোটে সিপিএমের প্রার্থী বামাচরন বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেছিলেন তৃণমূল প্রার্থী সুভাষ মণ্ডল । তৃণমূল পেয়েছিল ৯২,২৩৪ টি ভোট । সিপিএমের ঝুলিতে ৮৫,৮৪২ টি ভোট পড়েছিল । অন্যদিকে তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপি প্রার্থী অঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১২,৯৩১ টি । কিন্তু ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে চিত্রটা অনেকটাই বদলে যায় । ভাতার বিধানসভায় সিপিএমকে সরিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি । বিগত লোকসভায় ভাতার বিধানসভা থেকে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৯৯,৩৮৩ । বিজেপি প্রার্থী এস এস আলুওয়ালিয়া পেয়েছিলেন ৭২,৯১৯ টি ভোট । সিপিএম প্রার্থী আভাষ রায়চৌধুরীর ঝুলিতে পড়েছিল মাত্র ২১,৭১২ টি ভোট । বর্ধমান-দূর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী জিতলেও ভাতার বিধানসভায় তাঁকে তৃণমূল প্রার্থী মমতাজ সঙ্ঘমিতা চৌধুরীর থেকে ২৬,৪৬৪ ভোটে পিছিয়ে থাকতে হয়েছিল ।
তবে এই পরাজয়ের মধ্যেও বিজেপির কাছে দুটি ইতিবাচক দিকও ছিল । প্রথমত, সিপিএমের ভোটব্যাঙ্কে যে ধস নেমেছিল তার সব ফায়দাটাই বিজেপি পেয়েছিল । দ্বিতীয়ত, ভাতার বিধানসভার ২৬৪ টি বুথের মধ্যে একশ’র অধিক বুথে জয় ছিনিয়ে এনেছিল বিজেপি । আর বিগত লোকসভার এই ফলাফলের জেরেই আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ভালো ফল করার বিষয়ে আশাবাদী স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব । শুধু বিগত লোকসভার ফলাফলই নয় বিজেপি নেতৃত্বের আশার পিছনে রয়েছে অন্য কারণও । তার মধ্যে অন্যতম হল তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল ।
স্থানীয় সুত্রে খবর,শাসকদলের প্রার্থীর নাম ঘোষনার পর প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক বনমালী হাজরাকে মাঝে মধ্যে প্রার্থীর সঙ্গে প্রচারে দেখা গেলেও দেখা মেলেনি বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক সুভাষ মন্ডলকে । যদিও এই বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও শাসকদলের কর্মী মহলে এনিয়ে চাপা আশঙ্কা রয়েছে । আগামী ভোটে এর প্রভাব যদি ভোটবাক্সে পড়ে তাতে বিজেপিই লাভবান হবে বলে মনে করছে পদ্ম শিবির ।
এছাড়া রয়েছে ভোটব্যাঙ্কের সমীকরন । কারন এবারে সিপিএম-কংগ্রেস জোট হয়েছে । তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আব্বাস সিদ্দিকীর দল । আর এই জোট থেকে বিজেপি অনেকাংশে উপকৃত হবে বলে মনে করছে বিজেপির নেতারা । তাঁরা রাখঢাক না করে বিভিন্ন সভা সমাবেশে তা প্রকাশও করে ফেলছেন । বিজেপি নেতৃত্বের এরূপ ভাবনার পিছনে রয়েছে মূলত মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের বিভাজন । গোটা রাজ্য জুড়েই তার প্রতিফলন ঘটতে চলেছে বলে মনে করছে গেরুয়া শিবির । তৃণমূলের মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে যদি সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী থাবা বসাতে পারে তাহলে জয়লাভ অনেক সহজ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন ভাতারের বিজেপি প্রার্থীর মহেন্দ্রনাথ কোঁয়ার । পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘বিজেপি জাতপাতের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না । সকল সম্প্রদায়ের মানুষ আমাদের পাশে আছে । কারন আমাদের দলীয় ইস্তেহারে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ, বিধবা ভাতা সহ মহিলাদের যে সমস্ত সুবিধা দেওয়ার কথা বলা আছে তা কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম বিশেষকে দেওয়ার কথা বলেননি মোদিজী । সকল সম্প্রদায়ের মহিলারাই ওই সুবিধা পাবেন ।’
এদিকে তৃণমূল নেতৃত্বের আশা সিপিএম যদি তাঁদের পুরনো ভোটব্যাঙ্ক পুনরুদ্ধার করতে পারে তাহলে তাদের জয়ের রাস্তা প্রশস্ত হয়ে যাবে । এই বিষয়ে সিপিএম প্রার্থী নজরুল হক বলেন, ‘বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় একটা আশ্রয়স্থল খুঁজেছিল মানুষ । তাই তারা বিজেপির দিকে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষাপট আলাদা । তাই এখন ফের তাঁরা সিপিএমের উপর আস্থা রাখতে শুরু করেছেন । আগামী ভোটে সেটা প্রমান হয়ে যাবে । এবারে ভাতার বিধানসভায় আমরাই জিতব ।’ যদিও বিজেপি প্রার্থীর দাবি, ‘এখন মানুষের মনে পদ্মফুল গেঁথে গেছে । সকল ধর্মের মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়ে জেতাবেন ।’
যদিও রাজনৈতিক মহলের দাবি,এবারের ভাতার বিধানসভায় লড়াইটা মূলত বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যেই হতে চলেছে । সেখানে সংযুক্ত জোটের প্রার্থীকে দেখা যাবে ভোট কাটাকাটির ভূমিকায় ।এখন জোট প্রার্থী কার ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসায় সেটাই দেখার । তা জানার জন্য ২ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ।।