এইদিন ওয়েবডেস্ক,বাংলাদেশ,১৪ জুলাই : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের একটি বিদ্যায়তনের শিক্ষক কলিম উল্লাহ কিছু দিন আগে তার পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। এসে উঠেছেন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মীয়র কাছে। সেখানে তাদের জীবন কাটছে ‘খুবই অমানবিক পরিবেশে’। রাখাইন এখন পুরোপুরি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেই, ৮০ শতাংশ এলাকা আরাকান আর্মির দখলে। তারপরও কেন মাতৃভূমি ছেড়ে এলেন মংডুর নাক্কুরা বুড়া সিকদার পাড়ার পঞ্চাশোর্ধ্ব কলিম উল্লাহ?
তিনি বললেন, “মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই নাজুক। মূলত সেখানে মুসলমানদের ওপর আরাকান আর্মি নির্যাতন করছে। তাই মুসলমানরা সেখানে থাকতে পারছেন না। যে যার মত পালিয়ে আসছে। আরাকান আর্মি মিয়ানমারকে শুধুমাত্র রাখাইনদের রাজ্য বানাতে চায়। তাই তারা মুসলমানদের সঙ্গে বৈষম্য করছে। মুসলিমদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। পুরুষদেরকে নির্যাতন করছে। এমনকি নারীদেরকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হয় সেখানে। পাড়ায়-পাড়ায় গিয়ে প্রতিটি ঘর থেকে আরাকান আর্মি চাঁদা তোলে।”
প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন রোহিঙ্গা মহম্মদ ইব্রাহিম ও খদিজা বেগমসহ আরও কয়েকজন; ইব্রাহিম এসেছেন মংডু শহরের হারিপাড়া থেকে, আর খদিজা ছিলেন একই শহরের নোয়াপাড়ার বাসিন্দা। পাঁচ কন্যার মা খদিজা এখন উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন চালান। তার স্বামী চলৎশক্তিহীন, শয্যাশায়ী। খদিজার কথায়, “আরাকান আর্মি আর জান্তা বাহিনী সবাই এক। ওরা এমন পরিস্থিতি বানিয়ে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করেছে।”
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাত থেকে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের দখল নেওয়ার পর সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হত্যা-নির্যাতন-অগ্নিসংযোগ অব্যাহত থাকায় এখনও প্রতিদিন মানুষ রাতের আঁধারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির খুব একটা ‘ফারাক’ দেখেন না নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। কারণ, আরাকান আর্মি মনে করে, শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত রোহিঙ্গারা ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা ও আরএসওকে সহায়তা করে।
রোহিঙ্গাভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) সঙ্গে আরাকান আর্মির দ্বন্দ্ব দেখে আসার কথা শোনা গেছে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মুখে। ফলে রাখাইন নিয়ে কিংবা মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়া নিয়ে খুব বেশি একটা ‘আশাবাদী’ হতে পারছেন না তারা।
অথচ চলতি বছর রোজার সময় ১৪ মার্চ উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে ২০ নম্বর ক্যাম্পে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সেদিন দুজনে এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে মিলে ইফতার করেছিলেন । ওই দিন ইউনূস রোহিঙ্গাদের দ্রুত তাদের মাতৃভূমিতে পাঠানোর কথা দিয়েছিলেন। পরের ঈদটি যেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নিজ ভূমিতে ফিরে করতে পারেন, সেজন্য নিজের প্রচেষ্টার কথা রোহিঙ্গাদের সামনে তুলে ধরেন ইউনূস; এজন্য তাদের জন্য “দোয়া”ও চান। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় (যা রোহিঙ্গাদের কাছেও সহজবোধ্য) ইউনূস বলেছিলেন, “আল্লার হাছে দোয়া গরি, সামনর ঈদত যেন অনারা নিজর বাড়িত যাইয়েরে ঈদ গরিন ফারন।”
এরপর ৪ এপ্রিল সরকার প্রধানের দপ্তর থেকে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ‘যোগ্য’ বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। এপ্রিলের শেষ দিকে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইন রাজ্য থেকে এই সময়ে আরও প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কাঁধে এখন প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার ‘বোঝা’।রাখাইনের জন্য ‘জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় মানবিক করিডোরের’ কথিত প্রস্তাবের বিষয়টিও রাজনৈতিকভাবে জোরালো আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
মংডুর নাক্কুরা বুড়া সিকদার পাড়ার বাসিন্দা কলিম উল্লাহর দাবি, ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা ঢলের পর সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা একসঙ্গে বাংলাদেশে এসেছে চলতি বছর। সেই সময় মংডু থেকে অনেকই চলে এলেও লাখ খানেকের মত রোহিঙ্গা শহর ও আশপাশের এলাকায় ছিল । এই অঞ্চলটিতে মানুষের আয়ের প্রধান উৎস চাষাবাদ, কেউ কেউ সাগরে মাছ আর কাঁকড়া ধরে সংসার চালাতেন।
সম্ভবত রাখাইনের সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা মংডুতে ছিল। কিন্তু চলতি বছর তার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মংডু ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মংডু, বুথিডং, রেথিডং এর মত শহরগুলো আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। মংডুতে বাকি যে হাজার পঞ্চাশেক রোহিঙ্গা আছে, তারাও আতঙ্কের মধ্যেই আছে এবং সুযোগ পেলেই ঘরবাড়ি ছেড়ে শরণার্থী হবেন বলে কলিম উল্লাহর ধারণা। তবে তিনি এ কথাও বলেছেন, আরাকান আর্মি তাদেরকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে। আর এসব তথ্য তিনি পেয়েছেন মংডুতে থাকা তার অন্য স্বজনদের মাধ্যমে। তিনি বলেন,“আরাকান আর্মি নিজেদের বদনাম না হওয়ার জন্য মুসলিমদের আটকে রেখেছে। যেন তারা দেখাতে পারে, মংডুতে পরিস্থিতি খারাপ নয়। কিন্তু অনেকে আরাকান আর্মির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে লুকিয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে।”
একদিকে যুদ্ধ-নির্যাতন, আরাকান আর্মির বাধা আর অপরদিকে রোহিঙ্গাদের প্রাণে বাঁচতে সাগর পাড়ি দেওয়া- এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সীমান্ত এলাকায় একটি ‘দালাল গোষ্ঠী’ও তৈরি হয়েছে; যাদের কাজ রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হতে সহায়তা করা।
কলিম উল্লাহ বলেন, আট সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা দশজন। তারা দালালের মাধ্যমে রাতের বেলায় নৌকায় করে বাংলাদেশে এসেছেন। প্রতিজনের জন্য দালালদের দিতে হয়েছে মিয়ানমারের ছয় লাখ কিয়াট; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৫ হাজার টাকার মত।
সীমিত চলাচল আর ‘ট্যাক্সের’ খাঁড়া
মংডুতে রোহিঙ্গারা যে পাড়ায় থাকে, সেখান থেকে খুব বেশি চলাচলের সুযোগ নেই। উপার্জনের ওপর আরাকান আর্মিকে ‘ট্যাক্স’ দিতে হয় বলে কলিম উল্লাহ জানালেন। তিনি বলেন, “আরাকান আর্মিকে ট্যাক্স দেওয়ার পরেও তারা মুসলিমদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিত। লুটপাট করত। অথচ তারা রাখাইনদের কাছ থেকে কোনো ট্যাক্স নেয় না। এ ছাড়া মাছ ধরতে গেলে কম বয়সী রোহিঙ্গা ছেলেদেরকে ধরে নিয়ে যেত, এমনকি কাউকে কাউকে মেরে ফেলত আরাকান আর্মি। কলিম উল্লাহ বাংলাদেশে আসার আগেও তিনজনকে মেরেছে এবং চারজনকে অপহরণ করেছে আরাকান আর্মি।
তার ভাষ্য, আরাকান আর্মির একটি সহায়তা সংস্থা আছে, যারা মিয়ানমারের রাখাইনদের খাদ্য সহায়তা দেয়। তবে এই সহায়তা মুসলিমরা পেত না। “উল্টো মুসলিমদের ঘরবাড়ি থেকে হাঁস-মুরগি চুরি করে, অর্থ-সম্পদ লুট করে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। মংডুর মানুষরা অনেক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। মৌসুমি ফলমুল খেয়ে কোনো মতে বেঁচে আছে।” তিনি বলেন, “এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যেতে দেয় না। নিজের পাড়ায় থেকে মাছ, কাঁকড়া আরাকানদের দালালদের কাছে বিক্রি করতে হয় স্বল্প মূল্যে। দালালরা ১০০ টাকার জিনিস ২০ টাকায় কিনে নেয়। কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন রোহিঙ্গারা।”
লুটপাটের কথা এসেছে মংডুর নোয়াপাড়ার খদিজা বেগমের ভাষ্যেও; তিনি এখন উখিয়ার টিভি টাওয়ার সংলগ্ন একটি ক্যাম্পে আত্মীয়র ঘরে থাকেন পাঁচ মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে। খদিজা বেগম নিজের মাতৃভাষায় বলছিলেন, “মগবাগি অল আঁইয়ারের আঁর কুরা গুনোরে গুলি মারের। তই জিজ্ঞাইয়েদই মারর ক্যা? ইতারা হদ্দে তোঁয়ারেরেও মারিয়ুম। জাগা ইন আঁরাত্তুন লাগিবু। হারা যউগুই!” [লোকজন (আরাকার আর্মি) এসে আমার পোষ্য মুরগিগুলো গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, মারছেন কেন? ওরা বলে, আমাদেরকেও মারবে। আমাদের জায়গা তাদের লাগবে। আমরা যেন চলে যাই।]
এরপর আর বাড়িতে থাকার সাহস করেননি খদিজা বেগম। তিনি নোয়াপাড়ার বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন হারিপাড়া এলাকায়।সেখানেও তখন আরাকান আর্মি আর জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি চলছিল। পরিস্থিতি খারাপ বুঝতে পেরে চলে যান কোণারপাড়া। এই পাড়ায় ১১ দিন থাকার পর তারা জাম্মুনার ক্যাম্প যান। সেই ক্যাম্পে এক মাসের মত ছিলেন।
খদিজা বলেন, “এরপর আমরা অনেক মানুষ পাহাড় বেয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে থাকি। কিন্তু আমার স্বামীর পায়ে অপারেশন। চলতে ফিরতে পারে না ভালোভাবে৷ কিছু মানুষ আমাদের সহযোগিতা করে টাকা দেয়। টাকা দিয়ে নৌকায় চড়ে নাফ নদী দিয়ে আমরা এপাড়ে চলে আসি। জাদিমুড়া এলাকায় পৌঁছালে সেখানে কয়েকজন এসে আমার মেয়ের স্বর্ণের কানের দুল ছিনিয়ে নেয়।”
‘জান্তা যাদের প্রশিক্ষণ দেয়, আরাকান আর্মি তাদের ধরে নেয়’
খদিজা বেগম যখন নিজের বাড়িতে ছিলেন তখন তিনি শুনেছেন, অনেক রোহিঙ্গা যুবককে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে ‘যুদ্ধের কাজে’ লাগাচ্ছে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ‘রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের’ বিষয়টি তখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও আসে। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে খদিজা বেগম বলছিলেন, “কিছু রোহিঙ্গা যুবককে জান্তা নিয়ে গিয়েছিল। পাড়ায় পাড়ায় খোঁজ করে যুবকদের নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের ট্রেনিং দেয়। হাতে অস্ত্রও দেওয়া হয়।
“কিন্তু জান্তার লোকজন যখন পালিয়ে যায় আরাকান আর্মি তখন এসব রোহিঙ্গা যুবকদের খুঁজতে থাকে। কিছু যুবককে ধরেও ফেলে তারা। এমনকি ছেলেদের না পেয়ে মা-বাবাকে ধরে নিয়ে যায়।”
হারিপাড়ার ইব্রাহিম বলেন, “আরাকান আর্মি মারলেও আমাদের মারত, জান্তা মারলেও আমাদের মারত।” তবে আরসা কিংবা আরএসও এর সঙ্গে মংডুর রোহিঙ্গা মুসলিমদের কোনো সমস্যা নেই বলে জানান কলিম উল্লাহ। সেটাও রোহিঙ্গাদের জন্য ‘কাল’ হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন। কারণ, আরাকান আর্মির সঙ্গে আরসা বা আরএসও এর সম্পর্ক ভালো নয় । “আরাকান আর্মি মংডুতে থাকা শিক্ষিত রোহিঙ্গাদের উপর বেশি নির্যাতন করে। তারা মনে করে, আলেম আর মাস্টাররা আরসার জন্য কাজ করে। অথচ আরসা আর আরএসও এর সদস্যরা থাকে মংডু থেকে ২০-৩০ মাইল দূরের পাহাড়ে। তারা ১০-১৫ দিনে একবার মংডুতে আসে”, বলেন কলিম উল্লাহ।
মংডু থেকে যারা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে এসেছেন, তাদের প্রায় সবাই দাবি করেছেন, সেখানে কিছু চাষাবাদ হয় বটে; কিন্তু চালসহ খাবার-দাবার বাংলাদেশ থেকেই চোরাই পথে সেখানে যায়।
তারা জানান, মংডুতে ৫০ কেজি চালের দাম মিয়ানমারের মুদ্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার কিয়াট; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকার মত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রাখাইনে আরাকান আর্মি থাকলে সেখানে ফিরে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই। নিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই শুধুমাত্র ফিরে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন কলিম উল্লাহ।
মংডুর হারিপাড়ার মো. ইব্রাহিম যখন দেশ ছাড়েন তখনও তার ধারণা ছিল না যে, তিনি আর মাতৃভূমিতে ফিরতে পারবেন না। কারণ, এক বছর আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন মূলত মায়ের চিকিৎসার জন্য। এখানে এসে উঠেছিলেন এক আত্মীয়র ঘরে। সবকিছু গুছিয়ে রাখাইনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনি শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে যুদ্ধ। সেখানে থাকা পরিবারের লোকজন ও স্বজনরা তখন ইব্রাহিমকে জানান, তাদের ফেরা ঠিক হবে না। ফিরলে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। তারপর থেকে তিনি উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই আছেন। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের বড় গণহত্যার পর যারা রাখাইনে থেকে গিয়েছিলেন তারা আসলে বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। কারণ, এরই মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে সেখানকার রাখাইন বৌদ্ধদের একটা সামাজিক-মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। এক গোষ্ঠীর প্রতি অন্য গোষ্ঠীর আস্থা-অবিশ্বাস প্রবল।
দুই বছর এভাবেই কেটে যায়। আড্ডায়-বাজারে মাঝে মাঝে কিছু রাখাইন যুবকের সঙ্গেও তাদের কথা হয়। সংঘাতের কারণে সবারই ক্ষতি হচ্ছিল। আর তাদের একটা ধারণা ছিল যে, রাখাইনের গ্যাস সম্পদ লুট করতেই এই যুদ্ধের আয়োজন করা হয়েছে, রাখাইন আর রোহিঙ্গাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে তারা সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘সম্প্রীতির পরিবেশ’ তৈরির চেষ্টা চালান। সেখানে ম্রোসহ আরও কয়েকটি জাতিসত্ত্বার প্রতিনিধিও ছিল।
২৫ জনের একটি দল এগিয়ে আসে জানিয়ে ইব্রাহিম বলেন, “আমরা বুঝতে পেরেছিলাম এ কাজটা কঠিন, তাই ওপেন করা যাবে না, ভেতরে ভেতরে কাজ করছিলাম। প্রীতি ফুটবল ম্যাচ করতাম। বৌদ্ধদের ক্যাং, মুসলিমদের মাদ্রাসা, হিন্দুদের মন্দির, চাকমাদের গীর্জায় গিয়ে শিশুদের পড়াশোনা করাতাম। এতে করে সৌহার্দ্য বাড়ছিল। অনেকে আবার এটাকে খারাপ নজরেও দেখত।
“আমরা আগে বৌদ্ধদের রাখাইন পাড়ায় যেতে পারতাম না, কিন্তু এটার পর আমরা ভয় ছাড়া সেখানে যেতাম। রাখাইনরাও মুসলিম পাড়ায় আসতে ভয় পেত, আমরা সেটা ঠিক করে ফেলেছিলাম। আমাদের একটা টার্গেট ছিল।” তিনি বলেন, “সবাই মুখে মুখে এটাকে ‘হয়রাতি অরগানাইজেশন’ বলত। আমরা কানুন বেঁধেছিলাম এখানে সবাই সমান। প্রেসিডেন্ট থেকে মেম্বার পর্যন্ত। ছয় মাস পর পর প্রেসিডেন্ট পাল্টাতাম। একবার একেক জাতি থেকে প্রেসিডেন্ট হত।”
রমজানে রোহিঙ্গাদের কাছে ইফতার করতে আসতেন রাখাইন বৌদ্ধরা, তাদের উৎসবেও রোহিঙ্গারা যেতেন জানিয়ে ইব্রাহিম বলেন, “কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ। সেটা আর হল না। এর মধ্যেই শুরু হল আরাকান আর্মি আর জান্তার যুদ্ধ।” সেই যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “ড্রোন দিয়ে হামলা হয়েছে। যুদ্ধটা আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর মধ্যে হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল রোহিঙ্গারাই। তাদের বসতি টার্গেট করে চলত হামলা। ২০২৪ সালের কোরবানির ঈদের আমাদের পাশের পাড়াতেই বোমা পড়ে একটি ঘরে। ভাত খাওয়ার সময় ওই পরিবারের সবাই একসঙ্গে মারা যায়। তারপর আর কীভাবে মানুষ সেখানে থাকে?”
আসলে কতজন এসেছে
আক্ষরিক অর্থে এখন বাংলাদেশে কত রোহিঙ্গা আছে, প্রতিবছর সেই সংখ্যার সঙ্গে আরও কতজন যুক্ত হচ্ছে- তার প্রকৃত হিসাব নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। সরকার বা আন্তর্জাতিক সংস্থা সবার কাছ থেকে কেবল ‘ধারণা’ মেলে। যেমন- সরকারিভাবে বলা হয়ে থাকে, এখানে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা আছে। কিন্তু স্থানীয়দের বিশ্বাস, গত আট বছরে ‘সংখ্যার’ খুব বেশি হেরফের হয়নি। গত এক বছরে রাখাইন রাজ্য থেকে কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা- ইউএনএইচসিআর এর কাছে ইমেইলে জানতে চেয়েছিল বাংলাদেশের নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ফিরতি মেইলে তারা বলেছে, “গত এক বছরে এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ১৯ হাজার নতুন আগত রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্রিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে অনেকেই এখনো নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় রয়েছে, তাই এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। “এর মধ্যে এপ্রিল ও মে মাসে প্রায় ২৫ হাজার নতুন আসা রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্রিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে।”
এদিকে, এক হালনাগাদ প্রতিবেদনে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি- ডব্লিউএফপি বলছে, গত কয়েক মাসে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে এবং বছরের শেষ নাগাদ আরও ৫০ হাজার রোহিঙ্গা আসতে পারে। এতে করে কর্তৃপক্ষের জন্য মৌলিক সেবা প্রদান করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ডব্লিউএফপি বলছে, সব মিলিয়ে ক্যাম্পে এখন আবাসন সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ নতুন আসা রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই থাকছে আত্মীয়-স্বজনের কাছে । উখিয়ার আশ্রয়শিবিরের ক্যাম্প-২৬ এর মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) মোহাম্মদ জাসিম জানান, তার ক্যাম্পে প্রায় ১৬ হাজার রোহিঙ্গা নতুন এসেছে। এদের সবাইকে এরই মধ্যে খাদ্য সহায়তার টোকেন দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, “আবাসনের জন্য এখন বিশাল সংকট চলছে। অনেকেই আত্মীয়দের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকছে। কেউ কেউ টেকনাফে গাছ কেটে এবং পাহাড় কেটে জায়গা তৈরি করে আশ্রয় নিচ্ছে।” বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মহম্মদ মিজানুর রহমান বলেন,’নতুন আগতদের জন্য প্রাথমিকভাবে অব্যবহৃত কমিউনিটি সেন্টার এবং ক্যাম্পের খালি জায়গায় আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’।

