জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,পূর্ব বর্ধমান,১৬ জানুয়ারী :প্রকৃতিতে সবকিছু সীমিত দেখে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডারউইন বলেছিলেন – Struggle for existence. অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াইয়ে কেউ জেতে কেউ হেরে যায়। আসলে আজও প্রকৃতিটা Fittest for the survival. যারা বেঁচে থাকে তাদের অনেকেই আবার Live & let live অর্থাৎ বাঁচো এবং বাঁচতে দাও- এই নীতি অনুসরণ করে চলেন। ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে – নিজে একমুঠো খাও সঙ্গে অপরের মুখেও কিছু খাবার তুলে দেওয়ার চেষ্টা করো। সেটা সামান্য অর্থের বিনিময়ে হলেও সমস্যা নাই। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’মুঠো অন্ন তো তুলে দিতে হবে !
সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি অফিসের চাকুরীজীবি সহ কাজের খোঁজে এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে বহু মানুষ প্রতিদিন জেলার সদর শহর বর্ধমানে আসে। একদল শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী আসে চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গৃহশিক্ষকদের কাছে আসে ছাত্রছাত্রীরা। শহরের উপর দিয়ে ছুটে চলে অসংখ্য দূরপাল্লার বাস ও ট্রেন। এককথায় বলা যেতেই পারে প্রতিদিন বহু মানুষের নিত্য আগমন ঘটে বর্ধমান শহরে। এদের কেউ বাড়ি থেকে টিফিন আনার সুযোগ পায় কেউ পায়না। এদের সবার মুশকিল আসান হয়ে ওঠে বর্ধমানের বড় নীলপুরের গৃহবধূ মুনমুন দে রাউৎ।
সংসারের প্রয়োজনে ‘হোম ডেলিভারি’-র কাজটা শুরু হয়েছিল বছর চারেক আগে। প্রায় চল্লিশ জন ব্যস্ত মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যেত খাবার। বলা যেত এই ছোট্ট সফল পদক্ষেপের বৃহত্তম সংস্করণ হলো ‘আয়শানি মুসুর’ রান্নাঘর – শিশুকন্যার নাম।
বর্ধমান শহর থেকে আলিশা যাওয়ার পথে পুলিশ লাইন পেরিয়ে রাস্তার ডানদিকে দেখা যাবে একটা ছোট্ট গুমটি। সেখানে সদা ব্যস্ত তিনজন মানুষ। কারণ সামনে লম্বা লাইন। সবার হাতে খাবার তুলে দিতে হবে যে। উচ্চ পদস্থ অফিসার থেকে শুরু করে কলেজের ছাত্রছাত্রী সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। এমনকি বাড়িতে হঠাৎ আসা আত্মীয়ের সেবা করার জন্য লাইনে হাজির পার্শ্ববর্তী এলাকার কোনো এক সদস্য। ওখানে যে কম খরচে ভাল ও সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়। খাদ্য তালিকায় আছে বাসন্তী পোলাও ও সঙ্গে চিকেন কষা বা মাটন। দামটাও সাধারণের নাগালের মধ্যে।
মোটামুটি বেলা ১ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই স্টল। প্রতিদিন প্রায় ৬০০-৭০০ জন এই স্টল থেকে খাবার সংগ্রহ করে। কেউ বসে খায়, কেউ বাড়িতে নিয়ে যায়। সবচেয়ে বড় সুবিধা এই খাবার ছোট থেকে বড় সবাই খেতে পারে। কারণ ঝাল বা ‘রিচ’ নয়। তবে ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় ভোরবেলা থেকে। অত লোকজনের রান্না করতে হবে! তবে এরজন্য অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করা হয়নি। সেক্ষেত্রে খাবারের দামটা বেড়ে যাবে। তাই পরিবারের সদস্যরা মিলেই সমস্ত বিষয়টি তদারকি করেন ।
কথা হচ্ছিল আরামবাগ থেকে আগত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মনীষার সঙ্গে। তার বক্তব্য, ‘আমি দূরশিক্ষার ছাত্রী। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সবদিন টিফিন নিয়ে যেতে পারিনা। এক বন্ধুর সঙ্গে যেদিন প্রথম ওখানকার খাবার সংগ্রহ করে খাই খুব ভাল লেগেছিল। এখন তো আর বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে যাইনা।’ শুধু মনীষা নয়, বর্ধমানে বিভিন্ন কাজে যারা যায় তাদের একটা অংশ সুযোগ পেলেই ওখানে চলে যায়। অনেকের বক্তব্য কার্জন গেটের আশেপাশে স্টলটা হলে কী ভালই না হতো! মাঝেমাঝে খাবারের স্বাদ নিতে পারতাম। আফসোস ঝরে পড়ে তাদের কণ্ঠে।
মুনমুন দেবীর বক্তব্য,’হোম ডেলিভারি থেকেই আমার স্টল চালু করার ভাবনাটা মাথায় আসে। অতিরিক্ত লাভ নয়, আমার লক্ষ্য সামান্য লাভের বিনিময়ে শহরে আগত মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া। সবার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি। সন্তানকে তো ‘মানুষ’ করতে হবে!’