জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,০৮ মে : বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্টের অন্যতম সাড়া জাগানো বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পরিসমাপ্তি ঘটল দীর্ঘ চার দশকের অধিক সময়ের আইনি লড়াই। শ্যামলী ঘোষ নামে ওই শিক্ষিকার পক্ষে রায় আসায় সামনে নিয়ে এলো এক রাশ প্রশ্ন । ন্যায় তো পেলেন ওই শিক্ষিকা কিন্তু এই ঘটনায় তৎকালীন শাসকদলের ধামা ধরা আধিকারিকদের মিথ্যা অভিযোগ এবং আদালতের দীর্ঘসূত্রিতার দায়ভার কে নেবে ? যে কারনে নষ্ট হয়ে গেলো শিক্ষিকার মূল্যবান চার চারটে দশক ।
জানা যাচ্ছে,শ্যামলী ঘোষ ১৯৭৬ সালে হাওড়ার শ্যামপুর এলাকার কোনো একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন । কোনো কারণ ছাড়াই, অন্তত সেটা শ্যামলী দেবীর কাছে অজানা থেকে গেছে এবং হয়তো আজও, ১৯৮০ সালে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তখন তাকে বিদ্যালয়ে আসতে নিষেধ করে দেন । শিক্ষা দপ্তরের দরজায় ঘোরাঘুরি করেও কোনো সুরাহা হয়নি। ন্যায় বিচারের আশায় ১৯৮৬ সালে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন। অবশেষে গত ৫ ই মে তিনি ন্যায়বিচার পান। বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ না পেলেও নিয়মানুযায়ী বিচার চলাকালীন ২০০৫ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বিচারক শিক্ষা দপ্তরকে সুদসহ ২৫ বছরের বেতন মিটিয়ে দিতে নির্দেশ দেয়। এরপরও হয়তো দপ্তর আর একদফা টালবাহানা শুরু করবে এবং ৭৬ বছরের বৃদ্ধা শ্যামলী দেবী শেষ পর্যন্ত টাকাটা হাতে পাবেন কিনা সন্দেহ হয়। যদি সেটাই হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের বেতনও স্থগিত রাখতে হবে । ‘দ্যাখ কেমন লাগে’ !
ঘটনাটা চার বছর আগে ক্ষমতায় আসা বামফ্রন্টের আমলের। বিদ্যালয় পরিচালন সমিতি বা স্থানীয় কোনো বাম নেতার নির্দেশ ছাড়া একজন শিক্ষিকার বিদ্যালয়ে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করার সাহস কোনো প্রধান শিক্ষকের হবে না। ঐ শিক্ষিকার পরিবর্তে যাকে বিদ্যালয়ে নিয়োগ করা হয় তার রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে খোঁজ নিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাছাড়া যাকে নিয়োগ করা হয় তিনি কি খুবই ক্ষমতাশালী যার জন্যই কি শিক্ষা দপ্তর পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামায়নি? তবে এই ঘটনা বাম আমলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র দূর্নীতি নয় খোঁজ নিলে আরও পাওয়া যাবে । বর্তমানে হুগলীর একটি বিদ্যালয়ে কর্মরত অবসরের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা বামবিরোধী জনৈক ইতিহাসের শিক্ষককে সমস্ত রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিজের গ্রামের বিদ্যালয়ে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। এমনকি পরবর্তি সময়ে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করা হয়। শুধু বাম আমলে নয় সমস্ত আমলেই এই ঘটনা দেখা যায়। তবে বাম আমল বলে ঘটনার তাৎপর্য আলাদা। যতই এই রাজ্যে বিভিন্ন নির্বাচনে বামেরা শূন্য হাতে ফিরুক দলটার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা আছে যেটা অন্য দলগুলোতে অনুপস্থিত। উর্ধ্বতন নেতৃত্বকে এড়িয়ে নীচু তলার পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।
যাই হোক একজন বা একাধিক ব্যক্তির ঔদ্ধত্বের বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার মাশুল জনগণের করের টাকায় মেটানো হবে কেন ? যারা কথায় কথায় জনগণের করের টাকা নয়ছয় করা হচ্ছে বলে সরকারের সমালোচনা করেন তারা কি বলেন? টাকাটা আদায় করা হোক সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষক, তৎকালীন পরিচালন সমিতির সদস্য সহ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বিদ্যালয় পরিদর্শক ও শিক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। অন্তত ভবিষ্যতে কেউ রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ভুল সিদ্ধান্ত নেবেনা ।
গণতন্ত্রের দ্বিতীয় শক্তিশালী স্তম্ভ হলো বিচারব্যবস্থা। প্রভাবশালী থেকে শুরু করে অভাবশালী প্রত্যেককেই সুবিচারের আশায় আদালতে যেতে হয়। বলতে হয় আইনের প্রতি আমাদের আস্থা আছে । সবার কাছেই আদালত মন্দিরসম এবং বিচারপতিরা ঈশ্বরতুল্য। তাদের রায়ের উপর অনেকের ভবিষ্যত নির্ভর করে। তারপরও সাড়ে তিন দশক পর একটি মামলার রায় আদালতের বিচারপতিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মী, উকিল এবং রাজ্য ও কেন্দ্রের আইন দপ্তরের ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করে। আদালতের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে সরাসরি সমালোচনার সুযোগ থাকলে হয়তো সাড়ে তিন দশক পর রায় নিয়ে কথা উঠতই । মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের যেভাবে প্রশংসা শোনা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে উনি না থাকলে কোনো দিনই এই মামলার ফয়সালা হতো না।
বিচারপতিদের কোনো সম্মেলন হলে তবেই জানা যায় সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টে কতগুলো বিচারপতির পদ ফাঁকা আছে। নিম্ন আদালতের শূন্য বিচারপতিদের পদ সংখ্যা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। শুধু তাই নয় কতগুলো আদালত কর্মীর পদ ফাঁকা আছে তাও অজানা থেকে যায়। দেশের লোকসংখ্যা বাড়লেও আদালতের সংখ্যা বাড়ছে না। উল্টে বিচারপতিদের পদ শূন্য থেকে যাচ্ছে যা ন্যায়বিচারের পথে প্রধান অন্তরায়। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে দেশের সরকারও চায়না দ্রুত ন্যায়বিচার হোক। কয়েকদিন আগে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির পদ প্রায় অর্ধেক ফাঁকা থাকা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জ্জী অভিযোগ করলে কেন্দ্রের আইন মন্ত্রী নাকি বলেন বিচারপতি নিয়োগে একটা পদ্ধতি আছে। শুধু বিচারপতি কেন যেকোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা পদ্ধতি আছে। সেই নিয়োগ পদ্ধতিকে কেন সরলীকরণ করা হচ্ছেনা যাতে দ্রুত নিয়োগ করা যায় ? সাধারণ মানুষ জানে না কিভাবে একজন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। তারা শুধু দ্রুত ন্যায়বিচার চায়। বিচারপতিরাও মানুষ। একজন বিচারপতিকে যদি একাধিক মামলার চাপ নিতে হয় তাহলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায় এবং এই একটা অনিচ্ছাকৃত ভুল একজনের জীবন শেষ করার পক্ষে যথেষ্ট। প্রতিবছর সংবাদ মাধ্যমে এই খবর সামনে আসে।
প্রায় শোনা যায় এক শ্রেণির অসৎ উকিলের জন্যেও নাকি বিচার প্রক্রিয়ায় দেরি হয়। কালো কোর্ট পরিধান করে মানুষটি যখন যায় সাধারণ মানুষ তখন তার দিকে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। অথচ তাদের একাংশ দ্রুত ন্যায়বিচারের পরিবর্তে মক্কেলকে শোষণ করতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটা ঠিক উকিলদের কোনো বেতন নাই। মক্কেল কাছ থেকে পাওয়া অর্থই তাদের আয়ের উৎস। ন্যায়বিচারের স্বার্থে উকিলদের নির্দিষ্ট আয়ের কথা সরকারকে ভাবতেই হবে। নাহলে সাধারণ মানুষের শেষ ভরসা বিচারব্যবস্থার উপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে গণতন্ত্রের পক্ষে যেটা বিপজ্জনক । নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রাখার জন্য উকিলদের সঙ্গে সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেককে সচেতন হতেই হবে।
কেন্দ্রে ও প্রতিটি রাজ্যে একজন করে আইনমন্ত্রী ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন ‘ডেপুটি’ আছে। অতীতে এদের অনেকেই মক্কেলের হয়ে আদালতে সওয়াল করেছেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা আছে। অথচ কোন আদালতে দীর্ঘদিন ধরে কতগুলো ‘পেণ্ডিং’ মামলা পড়ে আছে, কতজন বিনা বিচারে বন্দী আছে অথবা মিথ্যা মামলায় ফেঁসে আছে সেসবের সমাধান নিয়ে এদের তৎপরতা দ্যাখা যায় না। শুধু তাই নয় বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও তৎপরতা দ্যাখা যায়না। একজন বিচারপতি কখন অবসর নেবেন সেটা জানা সত্ত্বেও কেন আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয় না ? নিজের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব যদি পালন করতে না পারেন তাহলে তাদের রেখে লাভ কি ?
কেন্দ্রে ও রাজ্যস্তরে আছে সংবিধান স্বীকৃত মানবাধিকার কমিশন। আছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। বিচারব্যবস্থার প্রতি সরকারি উদাসীনতার জন্য কত মানুষের মৌলিক অধিকার নষ্ট হচ্ছে তার ইয়ত্তা নাই। সুতরাং এইসব সংস্থাকে এটা নিয়ে ভাবতেই হবে এবং সক্রিয় হতে হবে।
অনেককেই ঠাট্টা করে বলতে শোনা যায় – আদালত মানে আনাগোনা, দাওদাও, লাঞ্ছনা ও তোষামোদ। এই দুর্নাম কি দূর করা যায়না যাতে শ্যামলী দেবীর মত কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে অথবা যাতে কাউকে বিনা বিচারে সাজা ভোগ করতে না হয় ?