এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১৬ সেপ্টেম্বর : পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিতর্কিত একটা গোষ্ঠী হল “বাংলা পক্ষ” । রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার আসার চার বছর পর ওই গোষ্ঠীটি ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন গর্গ চ্যাটার্জি নামে জনৈক এক ব্যক্তি । অনেকে গোষ্ঠীটিকে তৃণমূলের ছায়া সংগঠন বলেও দাবি করেন । গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে ‘বাঙালির অধিকার রক্ষা’র নামে হিন্দি ভাষীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ও রাজ্যে প্রাদেশিকতার বিষ ছড়ানোর অভিযোগ ওঠে বারবার । কিন্তু শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকার সুবাদে তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ।
“বাংলা পক্ষ”-এর প্রতিষ্ঠাতা গর্গ চ্যাটার্জি আদপে একজন বাংলাদেশি বংশভূত । যে কথা তিনি নিজে স্বীকার করেছেন । ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর তিনি নিজের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশের একটি ভবনের ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন,”খুলনা আমার ঠাকুমা, যাকে আমি দাদি বলে ডাকতাম, সেই লীলা (বিবাহের পরে প্রতিমা) চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভূমি। সেই খুলনার বিপিএল টিম খুলনা টাইটান্স-এর স্পনসর হলো ঢাকার ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস, বাংলাদেশ -যেখানে আমি ভিসিটিং প্রফেসর। অভিনন্দন। সঙ্গে দিলাম আমার দাদির বাপের বাড়ির ছবি। এখানে আমি গেছি।”
ওই পোস্টটির স্ক্রীন শর্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে গর্গ চ্যাটার্জিকে তীব্র ভাষায় নিশানা করেছেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ও বিজেপির যুবনেতা তরুনজ্যোতি তিওয়ারি । তিনি লিখেছেন,
‘যাদের পরিবার পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে অত্যাচারিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে, তাদের স্মৃতিতে এখনো সেই দুঃসহ দিনগুলো রয়ে গেছে। তারা জানে কিভাবে সর্বস্ব লুট হয়েছিল, কিভাবে মৌলবাদী নিপীড়ন তাদের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করেছিল। তাই তারা কোনও ভণ্ডামি করে সেকুলার নাটক দেখায় না বা অযথা তোষণও করে না।অন্যদিকে, যাদের পরিবার তখনকার পরিস্থিতিতে সুবিধা পেয়েছিল, তাদের মধ্যে ভিন্ন মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। তারা আজও ইতিহাসের সেই অন্ধকার অধ্যায়কে আড়াল করতে চায় ভাষার দোহাই দিয়ে। তাদের পরিবারের বৃদ্ধি হয়েছিল হয়তো ওই মৌলবাদীদের দয়ায় এবং তাদের শরীরে ওই মৌলবাদীদের রক্ত বইছে। এদের বাপ ঠাকুরদা যেটা করতে পারেনি সেটা হয়তো বাংলাদেশী মৌলবাদীরা করেছিল এবং যার ফলে এদের বংশবৃদ্ধি হয়েছিল সেই কারণেই বেশি ভালোবাসা হয়তো।’
উল্লেখ্য,বাংলাদেশের বিভিন্ন উগ্র ইসলামি সংগঠনগুলি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা,আসাম সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিকে সংযুক্ত করে অখন্ড বাংলাদেশ গঠনের ডাক বহুদিন ধরে । শেখ হাসিনাকে অনৈতিকভাবে উৎখাতের পর তাদের সেই সুপ্ত বাসনার কথা নতুন করে প্রকাশ করতে শুরু করে । তবে শুধু বাংলাদেশের উগ্র ইসলামি সংগঠনগুলিই নয়, গর্গ চ্যাটার্জির মত কিছু ব্যক্তিদের কাছ থেকেও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে ‘বৃহত্তর বাংলা’ নামে একটা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের কথা শোনা গিয়েছিল বলে দাবি করা হয় । এই বিষয়ে তরুনজ্যোতি তিওয়ারি লিখেছেন,’আজকাল দেখা যাচ্ছে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অরাজনৈতিক নাম নিয়ে আবার নতুন কৌশল নিচ্ছে। আগে যারা “Greater Bangladesh” এর মতো ধারণা প্রচার করত, এখন তারা খোলস বদলে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি, বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হিন্দু বাঙালি এবং বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ—এই তিনকে একসাথে “বাঙালি” বলে নতুন গল্প দাঁড় করাচ্ছে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট—ইতিহাসের বাস্তবতাকে মুছে দিয়ে ভিন্ন রকম প্রভাব তৈরি করা। বাংলা পক্ষ এবং গর্গ চট্টোপাধ্যায় এদেরই প্রতিনিধি। এরা ইতিহাস ভোলানোর চেষ্টা করছে।’
তিনি লিখেছেন,’এদের অতীতের পোস্টগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন এদের আসল উদ্দেশ্য কি। পশ্চিমবঙ্গ কে আলাদা করে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করার ষড়যন্ত্র করে চলেছে এরা। দেশ টুকরো করার যে পরিকল্পনা মৌলবাদীদের আছে এরা তারই অংশ ।’ তরুনজ্যোতির শেয়ার করা গর্গ-এর ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর একটা পুরনো পোস্টে লেখা হয়েছিল, “কাল ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১-এ এই দিনেই বাংলার ২/৩ অংশ মুক্তি পায় বাংলার বাইরে থেকে শাসিত হবার ক্লেদ থেকে। জয় বাংলা।” এমনকি তিনি কালো গোলাকৃতি পটভূমিতে “স্টেট বেঙ্গল” লেখা লোগো ব্যবহার করতেন তখন ।
বিজেপির যুবনেতা বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন,’কিন্তু প্রশ্ন হলো—যারা নিজেদের বাঙালির প্রতিনিধি বলে দাবি করেন, তারা কি কখনো পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব সমস্যা নিয়ে সরব হন? রেশন দুর্নীতি, চাকরির দুর্নীতি,সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ এবং প্রতি ক্ষেত্রে দুর্নীতি,এসব বিষয়ে তাদের নীরবতা চোখে পড়ে। বরং দেখা যায়, অনেক সময় এদের অবস্থান শাসক দলের পক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। অতীতের কিছু ছবি ও বক্তব্যে মৌলবাদী মহলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও স্পষ্ট হয়েছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ হিন্দু বাঙালিরা বুঝে গেছেন, কারা আসলে এই তথাকথিত “ভাষাপ্রেম” আর “বাংলালাভ” এর আড়ালে অন্য এজেন্ডা চালাচ্ছে।’
সবশেষে তরুনজ্যোতি তিওয়ারি লিখেছেন,’ইতিহাস ভুলে যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ বিপদের দরজা খোলা।যারা সত্যকে আড়াল করতে চায়, তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।এদের সাথে বিভিন্ন মৌলবাদীদের ছবি আপনারা দেখেছেন। এদের সাথে বাংলাদেশী মুসলমানদের যোগাযোগ আছে তার ছবি বেশ কয়েকবার সামনে এসেছে। গর্গ চট্টোপাধ্যায় প্রায় বাংলাদেশ যেতেন। লেকচার দেওয়ার নামে যেতেন তারপর কি করতেন সেটা তার কার্যকলাপ থেকে পরিষ্কার।’
প্রসঙ্গত,অসমে দায়ের হওয়া পুরনো মামলায় তৃণমূল সমর্থক গর্গা চ্যাটার্জিকে ২০২২ সালের আগস্টে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গৌহাটি হাইকোর্টের নির্দেশে কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে। তবে আদালত তাকে জামিন মঞ্জুর করেছিল, তার বিরুদ্ধে মামলার শুনানির জন্য গুয়াহাটির সিজেএম আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেয়। আসলে,২০২০ সালের জুন মাসে আসামের ডিব্রুগড়ে গর্গা চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে আহোম সম্প্রদায়ের অবমাননা করার অভিযোগে একটি এফআইআর দায়ের করা হয়। আসামে বিজেপিকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে, গর্গা ৬০০ বছর ধরে আসামে রাজত্বকারী আহোম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সুকাফাকে ‘চীনা আক্রমণকারী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আসামের একটি আদালত তার বিরুদ্ধে দুটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ দুই বছর ধরে সেই পরোয়ানা কার্যকর করেনি। ২০২২ সালের জুন মাসে, গৌহাটি হাইকোর্ট এই নিষ্ক্রিয়তার জন্য পশ্চিম সরকার এবং পুলিশকে তিরস্কার করে এবং ছয় সপ্তাহের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেয়। ফলস্বরূপ, কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয় । তবে, কলকাতার একটি আদালত তাকে জামিন মঞ্জুর করে, ১৭ সেপ্টেম্বর কামরূপ মেট্রো চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয় । এই ঘটনাতেই প্রমান যে গর্গ চ্যাটার্জির মাথায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অদৃশ্য হাত আছে । যেকারণে সে প্রাদেশিকতার বিষ ছড়িয়ে গেলেও রাজ্য পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়না বলে অভিযোগ ।।