এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১৩ মার্চ : বছর দুয়েক আগে পঞ্চায়েত ভোটের আবহে আলিপুরদুয়ারে এক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে, ‘আউটসাইডার’দের (বহিরাগত) নিয়ে এসে আপনাদের মাথাটা খাচ্ছে। মানুষের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাইছে।’’ তার নিশানায় ছিল মূলত ভিন রাজ্যের মানুষ । তৃণমূলের ‘ছায়া সংগঠন’ বলে পরিচিত কলকাতা ভিত্তিক ‘বাংলা পক্ষ’ও একই কথা বলে কার্যত প্রাদেশিকতার বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে । ওই সংগঠনের মূল পান্ডা গর্গ চ্যাটার্জির কাছে আবার নিজের দেশের হিন্দিভাষীদের থেকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের অনেকবেশি গ্রহণযোগ্য । প্রকাশ্য জনসভায় এনিয়ে তাকে মাঝে মধ্যে হাতিয়ারও করেছে । আসলে, এরাজ্যের হিন্দিভাষী হিন্দুরা মূলত বিজেপির সমর্থক । তারা একচেটিয়া ভাবে বিজেপিকেই ভোট দিয়ে আসছে । আর এই কারনেই মমতা ও তার দলের রোষানলে পড়তে হয়েছে হিন্দিভাষী হিন্দুদের বলে মনে করা হয় ।
যাই হোক, মমতা ব্যানার্জি ও তৃণমূলের এই ‘বহিরাগত’ মন্তব্যের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করে জবাব দিয়েছেন রাজ্য বিজেপির যুবমোর্চার নেতা ও কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী তরুনজ্যোতি তিওয়ারি । এনিয়ে তিনি আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা তথ্য সমৃদ্ধ পোস্ট করেছেন । তরুনজ্যোতি লিখেছেন,’বাংলার জনবিন্যাস ও সংস্কৃতির বহুত্ববাদ: ঐতিহাসিক পর্যালোচনা।
বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি কোনো একক জাতিগোষ্ঠীর তৈরি নয়, বরং এটি বহু সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফল। বিশেষ করে সেন রাজাদের আমলে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈশ্যদের একাংশ উত্তর ভারত থেকে বাংলায় এসেছিলেন। আজ যারা ‘বহিরাগত’ বিতর্ক তুলছেন, তারা হয় ইতিহাস জানেন না, নয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ব্যাখ্যা করছেন।
উত্তর ভারত থেকে বাংলায় অভিবাসন: ঐতিহাসিক পটভূমি
১. সেন শাসনের ভূমিকা
সেন রাজবংশের শাসকরা কর্ণাটক অঞ্চল থেকে এসেছিলেন এবং ১১-১২ শতকের দিকে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। তারা বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈশ্যদের বাংলায় আমন্ত্রণ জানান।
২. ব্রাহ্মণদের আগমন
চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় উপাধিধারী ব্রাহ্মণরা মূলত কনৌজ (কান্যকুব্জ) অঞ্চল থেকে বাংলায় আসেন।
- সেন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা বাংলার ধর্মীয় ও শিক্ষাগত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
- এছাড়া মৈথিলী ও দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণদেরও বাংলায় আনা হয়।
৩. কায়স্থদের আগমন
সেন আমলে কায়স্থরা প্রশাসনিক কাজের জন্য উত্তর ভারত থেকে আসেন। দাস, দত্ত, মিত্র, কর, ঘোষ প্রভৃতি কায়স্থ উপাধিধারীরা মূলত সেন শাসনের সময় থেকেই বাংলায় বিস্তার লাভ করেন। তারা সেন শাসনকালে প্রশাসনিক ও লেখার কাজ (লিপিকর, হিসাবরক্ষক) সামলাতেন।
৪. বৈশ্যদের আগমন
বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য সেন রাজারা উত্তর ভারত ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে বৈশ্যদের বাংলায় বসতি স্থাপন করতে উৎসাহিত করেন। সেন আমলে আগত বৈশ্যদের মধ্যে গুপ্ত, সাহা, কৌশিক ইত্যাদি পদবীধারীরা উল্লেখযোগ্য।
বাংলার সংস্কৃতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব
বাংলার ভাষা, ধর্ম, রীতিনীতি এবং সাহিত্য মৈথিলী ও উত্তর ভারতের সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে।
১. মৈথিলী ও বঙ্গসংস্কৃতির যোগসূত্র
বাংলার ব্রাহ্মণ্যধর্মে মিথিলার প্রভাব লক্ষ করা যায়। পঞ্চোপাসনা, গায়ত্রী মন্ত্র এবং নির্দিষ্ট কিছু ব্রত ও আচারের মধ্যে মৈথিলী প্রভাব স্পষ্ট।
বাংলার ‘পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণ’ শ্রেণিভুক্ত ব্রাহ্মণদের মধ্যে মৈথিলী ব্রাহ্মণদের একটি অংশ ছিল।
২. চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বপুরুষ ও মৈথিলী যোগ
চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বাশ্রমের পদবী ছিল ‘মিশ্র’, যা উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণদের পরিচয় বহন করে। - তার গুরু ঈশ্বর পুরীও ছিলেন মৈথিলী ব্রাহ্মণ।
৩. সাহিত্য ও ভাষায় বহুমাত্রিক প্রভাব
কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ অনুবাদ মৈথিলী ও ব্রজ ভাষার কিছু প্রভাব বহন করে। চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল কাব্যতেও উত্তর ভারতীয় কাব্যরীতির ছাপ দেখা যায়।
বর্তমান ‘বহিরাগত’ বিতর্ক ও বাস্তবতা
বাংলা বহু জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে। আজ যারা অন্যদের ‘বহিরাগত’ বলে চিহ্নিত করছেন, তারা নিজেরাই হয়তো একসময় বাংলায় স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা অথবা ইচ্ছাকৃত অপব্যাখ্যার মাধ্যমেই এই বিতর্ক তৈরি হচ্ছে।
বাংলা কখনো একক কোনো জাতির সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল না। এটি উত্তর ভারতীয়, মৈথিলী, আর্য, দ্রাবিড় এবং স্থানীয় অস্ট্রিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গঠিত একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য।
বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস কোনো নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর একক অবদান নয়। বহুমাত্রিক সংস্কৃতি বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই ইতিহাস বিকৃত করে রাজনীতি করা শুধু আত্মঘাতী নয়, এটি বাংলার প্রকৃত ঐতিহ্যকেই অপমান করার শামিল।
এরা মূলত বিভিন্ন ভাষাভাষী হিন্দুদের বহিরাগত বলে আক্রমণ করেন এবং অদ্ভুতভাবে মুসলমানদের আপন করে নেন।। এদের কাছে প্রভু শ্রী রামচন্দ্র বহিরাগত, শ্রী গনেশ বহিরাগত কিন্তু হযরত মুহাম্মদ ঘরের ছেলে।। এদের কথা শুনলে মনে হয় হযরত মুহাম্মদ যেন বরাহনগরে জন্মেছিল।। বহিরাগত এবং রোহিঙ্গা মুসলমানরা এদের কাছে আপন।। যে মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিকে এখনো আপন করতে পারেনি তারা এদের কাছে প্রাণের প্রিয় হয়ে উঠেছে কিন্তু হিন্দুরা নয়।। হিন্দুদের ভাগ করাটাই এদের একমাত্র কাজ।।
এরা অনেক সময় প্রচার করে যে মাছে-ভাতে বাঙালি অর্থাৎ যে মাছ খাবে না সে নাকি বাঙালি নয়।। অনেক বাঙালি হিন্দু আছেন যারা নিরামিষাসী, অনেক বৈষ্ণব আছেন যারা নিরামিষাসী— তারা কি বাঙালি নয়?
এরা প্রচার করেন যে কালী পূজোয় বলির মাংস না খেলে নাকি বাঙালি হওয়া যায় না।। এদের মুসলমান সমর্থকদের বলির মাংস খাওয়াতে পারবে তো? হালাল ছাড়া মাংস খাবে তো তারা? হালাল মাংস ভারতবর্ষ বা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি কবে থেকে হলো? ইসলামের ইতিহাস মাত্র ১৪০০ বছরের।। হিন্দুদের অর্থাৎ সনাতনীদের ইতিহাস অনেক পুরনো।। রাজনৈতিক দলের হাতে তামাক খেয়ে একদল গোষ্ঠী এই বহিরাগত ফর্মুলা বাজারে চালু করেছে হিন্দুদের ভাগ করার জন্য।।
তথ্যসূত্র:
- “A History of Bengal” – R.C. Majumdar
- “Banglar Itihas” – Niharranjan Ray
- “Caste and Race in India” – G.S. Ghurye
- “Medieval Bengal” – Aniruddha Ray.