ভারতীয় পন্যের উপর দু’ধাপে ২৫% করে মোট ৫০% শুল্ক চাপিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প । কারণ নাকি রাশিয়া থেকে তেল কিনে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পুতিনকে সাহায্য করা । তবে এটি প্রধান কারণ নয়। এই শুল্ক হামলার বাইরে আরও বেশ কিছু কারন আছে যাতে ট্রাম্প ব্যর্থ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং আরও অনেক কারণে প্রবল অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে আছে । মোদী সরকার এটা খুব ভালো করেই জানে ।
রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের তেল কেনা অব্যাহত রাখা কেন কারন নয় ?
ন্যাটো মিত্র তুরস্ক ৪৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রাশিয়ান পণ্য আমদানি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ গ্রুপ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৩৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের গ্যাস জাত রাশিয়ান পণ্য আমদানি করেছে। চীনকে শুল্ক থেকে ৯০ দিনের ছাড় দিয়েছেন ট্রাম্প । কিন্তু রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের বৃহত্তম আমদানিকারক হল চীন । এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ৩.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সার এবং ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় ধাতু রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে ।
তারপরেও রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনার জন্য ট্রাম্প কেন ভারতের পিছনে লেগেছেন ?
আসলে রাশিয়া থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল কেনা কখনই মুখ্য কারণ ছিল না । তাহলে এর পিছনে কারন কী ? এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কারন হল, ট্রাম্পের লবিস্টরা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে এবং তা তাদের ইচ্ছা অনুরুপ ঘটছে না।
ট্রাম্প ইউক্রেনে পুনর্গঠন ব্যবসার ১ ট্রিলিয়ন ডলারের সুযোগ দেখেছিলেন৷ এটি তিনি নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন ৷ তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘন্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতি করাবেন । কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। যুদ্ধ থামানোর ট্রাম্পের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি চীন এবং ভারতের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন । তবে তাদের কেউই মনোযোগ দেয়নি। চীন হয়তো সামান্য আগ্রহ দেখিয়েছে কিন্তু ভারত একেবারেই ট্রাম্পের কথায় গুরুত্ব দেয়নি । তিনি ভারতীয়দের ব্যাকচ্যানেলের মাধ্যমে পুতিনকে যুদ্ধবিরতির জন্য রাজি করানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন, এই বলে যে নাহলে ভারত রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা বন্ধ করে দেবে। ভারত এবং চীন যদি কথা না শোনে তাহলে উভয় দেশকে শুল্ক হামলার হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন ট্রাম্প।
এখন ঠিক তাই ঘটছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ না হলে ট্রাম্প এবং তার সহযোগীরা কীভাবে ট্রিলিয়ন ডলারের পুনর্গঠনের সুযোগটি বাস্তবায়িত করবে? ভারত মধ্যস্থতা করতে পারে কিন্তু কোনও হুমকির মুখে নয়।
তবে এটাই একমাত্র কারণ নয় । ট্রাম্প বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে অর্থাৎ ব্রিকস দেশগুলিতে দুগ্ধ ও কৃষি পণ্যের প্রবেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারত মার্কিন কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্য বাজারে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। এখানেও চাপ তৈরি হচ্ছে।
ট্রাম্পের ক্রিপ্টো পুশ:
ক্রিপ্টো চুক্তির জন্য ট্রাম্পের প্রথম পছন্দের দেশ ছিল ভারত, কিন্তু ফের ভারত ট্রাম্পের এই প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছে । পাকিস্তানিরা তাদের সম্পদের অবমূল্যায়ন থেকে রক্ষা করার জন্য ক্রিপ্টোতে বিনিয়োগ শুরু করায় ট্রাম্প পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এনিয়ে ট্রাম্প পাকিস্তানের সাথে চুক্তি করে ফেলেন । কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও পক্ষেরই কোনও উল্লেখযোগ্য লাভ হয়নি। এই চুক্তির কারণে, ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী বলে পাকিস্তানের মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নোবেল পুরস্কারের দৌড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই সুযোগটি ভেবেছিলেন । কিন্তু এই বুদবুদটি ফেটে যায় যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদ অধিবেশনে অস্বীকার করেন যে কোনও বিশ্বনেতা তাকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাননি।
দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা
ট্রাম্প দেশের মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য, বিশেষ করে মুদিখানা সামগ্রীর দাম এবং সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তবে, অনেক আমেরিকান এখন বিশ্বাস করেন যে দাম কমার পরিবর্তে বেড়েছে, ৬৪% মার্কিন বিশ্বাস করেন যে মুদিখানা সামগ্রীর দাম আরও বাড়বে এবং বেশিরভাগই মনে করেন যে ট্রাম্পের নীতির অধীনে দেশের অর্থনীতির অবনতি হচ্ছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তার অনুমোদনের হার ৩৯%-এ নেমে এসেছে, যা তার সর্বকালের সবচেয়ে খারাপ রেকর্ড, যদিও তিনি এটি সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচনী প্রচারে ।
আমেরিকানরা কি ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধের পক্ষে ?
আমদানির উপর শুল্ক আরোপ ছিল ট্রাম্পের একটি প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি যার লক্ষ্য ছিল মার্কিনদের চাকরি এবং শিল্প রক্ষা করা। তবুও, বেশিরভাগ আমেরিকান মনে করেন যে সাহায্য করার পরিবর্তে এই শুল্ক হামলা ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে এবং বাণিজ্য ব্যাহত করে মার্কিন অর্থনীতির ক্ষতি করছে । প্রায় ৫৭-৭১% মার্কিন বিশ্বাস করে যে ট্রাম্প যেভাবে শুল্ক পরিচালনা করেছেন তাতে দেশবাসীকে আরও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মুখে পড়তে হচ্ছে এবং অনেকেই উচ্চ ব্যয়ের কারণে ক্রয় অভ্যাস পরিবর্তনের কথা জানিয়েছেন ।
ট্রাম্পের শুল্ক হামলার বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে ভারত ও রাশিয়া ?
এদিকে মার্কিন শুল্ক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এড়াতে ভারত ও রাশিয়া আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক আকারে কাজ করছে। বর্তমানে লেনদেনের জন্য ডলারই কেন্দ্রীয় মুদ্রা এবং SWIFT ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ভারত ও রাশিয়া এখন রুবেল-রুপির বাণিজ্যের জন্য একটি ব্যবস্থা তৈরির জন্য কাজ করছে। এটি মার্কিন ডলারমুক্তকরণকে ত্বরান্বিত করছে। ভারত ও রাশিয়া যদি তা করে তবে অন্যান্য দেশও একই কাজ শুরু করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা বাজারে ভারতের অনুপ্রবেশ
ভারতও কিছু অংশ নিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা বাজারে। অপারেশন সিন্দুরের আগে ভারতের F-35 ক্রয়ের জন্য কিছুটা ইতিবাচক মনোভাব ছিল। অপারেশন সিন্দুর এবং ট্রাম্পের মন্তব্যের পর, F-35 ভারতের তালিকা থেকে নেমে এসেছে এবং Su-57 নতুন পছন্দের যুদ্ধবিমান হয়েছে । শুধু তাই নয়, ভারতের নিজস্ব প্রতিরক্ষা পণ্যগুলি ব্রাজিল এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলির মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলিতে বিশ্বব্যাপী চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি । এর সাথে ট্রাম্পের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই তবে এটি রিপাবলিকান অনুগতদের অর্থাৎ প্রতিরক্ষা নির্মাতাদের জন্য কিছুটা সমস্যা তৈরি করছে। শেষ পর্যন্ত তারা ট্রাম্পের উপর চাপ তৈরি করছে।
তবে ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এখানেই শেষ নয় । ফেডের সুদের হার কমানোর কোনও সুযোগ নেই। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি গভর্নর পাওয়েলের বিরুদ্ধেই ছিল । এমনকি সাম্প্রতিক বৈঠকেও মুদ্রাস্ফীতির কারণে কোনও সুদের হার কমানোর অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তাই বাজার নতুন বিনিয়োগের জন্য খুব বেশি উন্মুক্ত হচ্ছে না, যা ট্রাম্পের ব্যক্তিগত এজেন্ডা এবং জনসাধারণের স্বার্থের সরাসরি ক্ষতি করছে ।
কিন্তু কেন এর ফলে ভারতের উপর শুল্ক আরোপ করা হল ?
আসলে, মার্কিন বাজারে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করার ট্রাম্পের একমাত্র উপায় হল ভারত ও চীনের মতো দেশে বিক্রি করার নতুন সুযোগ তৈরি করা, নতুন দেশ গড়ে তোলার সুযোগ, যেমন ইউক্রেন। কিন্তু বাস্তবে এর কোনওটিই হচ্ছে না। ট্রাম্পের চাপে ভারত রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত নয়।
তার নোবেল পুরস্কারের স্বপ্নও ভেঙে পড়েছে। ক্রিপ্টো তহবিল চুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, MAGA এবং লবিস্টরা এখনও কিছুই পায়নি।
অন্যদিকে, পুতিনের সাথে NSA অজিত ডোভালের বৈঠকে একাধিক এজেন্ডা রয়েছে:
১. প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর ত্বরান্বিত করা ।
২. ভারত রাশিয়া জ্বালানি সহযোগিতা ।
৩. ভারত-রাশিয়া আর্থিক ব্যবস্থা ।
৪.রাশিয়ায় ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধি – বর্তমানে রাশিয়া ভারতে ৫৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে এবং মাত্র ৫-৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে।
নতুন এফটিএ-এর আওতায় যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়া এবং অন্যান্য উচ্চ আয়ের কোম্পানিগুলি ভারতীয় পণ্য বেশি আমদানি করার ফলে, ভারত তার বাণিজ্যকে বৈচিত্র্যময় করছে। মার্কিন ভোক্তারা ট্রাম্প-বিরোধী হয়ে উঠছে কারণ শুল্ক শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।
এখন প্রশ্ন হল আমেরিকা থেকে আমদানি করা ০.৫ ডলারে টুথব্রাশ, ০.১ ডলারে প্যারাসিটামল ইত্যাদি ভারত কি তৈরি করতে পারে না ? যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা হত তাহলে আইফোনের দাম ৩০০০ ডলার বেড়ে যেত । বর্তমানে আইফোন ভারতেই তৈরি হচ্ছে । ট্রাম্পের জন্য এটি হতাশার আরেকটি কারণ । ট্রাম্প যখন অ্যাপল এবং আরও কয়েকজনকে ভারত থেকে সরে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে ছিলেন, তখন তারা ট্রাম্পের কথায় গুরুত্ব দেয়নি।
তাই, শুল্ক হামলার জন্য রাশিয়ান তেল কখনই কারণ নয়। এটি ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা থেকে মনোযোগ সরিয়ে তার লবি এবং তার সমর্থকদের দিকে নিয়ে যাওয়ার উপায় মাত্র । ট্রাম্প ভেবেছিলেন ভারতকে প্রথমে বন্ধু বলে এবং তারপর হাত বাঁকিয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবেন । কিন্তু ভারত সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ ভুল হয়েছে ।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চলতি মাসে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে চীন যাবেন। ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে দুই দেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের পর প্রধানমন্ত্রী মোদী প্রথমবারের মতো চীন সফর করবেন। তার এই সফর ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর করার সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকে চীন ভারতের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করছে। ভারতও এতে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নিতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে ।।