ছোটোবেলা থেকে যখন মামাবাড়ি বেড়াতে আসতাম হঠাৎ হঠাৎ আকাশে উড়ে যাওয়া প্লেন দেখতে দেখতে কিছুটা দূর পিছু পিছু নিজেও দৌড়ে যেতাম। খুব কাছ থেকে অনুভব করতাম। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি তাই স্বপ্নের মধ্যেই ভেসে যেতাম একদিন আমি ও প্লেনে চড়ে পাড়ি দেবো ওই দূরের আকাশটা ছুঁয়ে আসবো। অনেক প্রশ্ন ছিল মনে, ওই আকাশটাতে কি আছে?
মেঘের ভেতর নিশ্চয়ই একটা মেঘের বাড়ি তো হবেই। কিন্তু সবাই বলে মেঘ হচ্ছে তুলোর মতো। তুলো ধরা যায় কিন্তু মেঘ ধরা যায় না। তাহলে এখানে আবার প্রশ্ন মানুষ চাঁদে যায় বলে সেখানে থাকা যায়! সেটা কেমন করে সম্ভব! বড় হওয়ার পরও প্রশ্ন বাড়তে থাকে, প্লেন তো এতো ভারী তবে আকাশে উড়ে যায় কিভাবে! কারণ আকাশ তো ফাঁকা! ভাবতে ভাবতে মাথা গুলিয়ে যায়।
বিয়ের পর যে পরিবারে এলাম সেও মধ্যবিত্ত পরিবার তাই প্লেনে ওঠা একটা দুঃস্বপ্ন। মনে মনে ভাবলাম – ও মেয়ে এতো স্বপ্ন দেখা ঠিক নয় ঘর সংসার সামলে মন শান্ত করো।
চুপ করে সামলাতে থাকি সবকিছু। কিন্তু স্বপ্নটা ওই সুদূর পানে রয়েই গেল। আকাশে গর্জন শুনলেই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এক ফাঁকে ছুটে যাই এখনও দেখতে।
একসময় ছেলে যে কখন বড় হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। বয়সটা আমিও পঞ্চাশ পার করেছি কখন মনে হয়নি। কিন্তু ছেলে মাঝে মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতো -‘মা’ দেখবে তুমিও একদিন ওই আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলেছো। চোখে জল আসতো বলতাম- “না রে স্বপ্নটা স্বপ্নেই রয়ে যাবে।” ছেলে মুচকি হেসে বলতো বেশ তো -“ওয়েট এন্ড সি”।
কাজের সুত্রে ছেলে মাঝে মাঝেই প্লেনে চড়ে পাড়ি দেয়। মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট চাপা হাসি পায় তবুও মনে মনে বললাম- যাক আমি না পারি ছেলে তো নিজের যোগ্যতায় যেতে পেরেছে তাতেই আমি খুশি। ওতেই আমি অনুভব করতে থাকি আকাশ পথে পাড়ি দেওয়া।
এবার কাজের সূত্রে ছেলে মুম্বাইয়ে বেশ কিছুদিন থাকতে গিয়েছে, ফিরবে কবে জানা নেই। কদিন পর সেখান থেকে ফোন করে ওর বাবাকে বলল – বাবা আমার শরীর ভালো নেই ডেঙ্গু হয়েছে। ওর বাবা অস্থির হয়ে পড়ে। কি করবে বুঝতে পারছে না। কিন্তু দুজনেই আমাকে চেপে গিয়েছিল চিন্তা করবো বলে। সন্ধ্যাবেলা ঘরে এসে জানালো সব কিছু। ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি ফোন করলাম ছেলেকে। তখন বলল- ‘মা’ আমি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছি। বড় একা লাগছে হসপিটালে ভর্তি। একটু আসবে ‘মা’ আমার কাছে?
মন উতলা হয়ে উঠেছে। ঘরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলাম। যেমন করে হোক আমি ছেলের কাছে যাবো। বলা মাত্রই ছেলের বাবা প্লেনের টিকিট কেটে পরদিন ভোরে ছুটে কলকাতা এয়ারপোর্টে। তবে তখন খুশির মুহুর্ত ছিল না, ছিল শুধু ছেলেকে কখন কাছে পাবো। শুধু হারিয়ে যদি যাই। প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা একদম নেই তাই কত্তামশাই সঙ্গ ছাড়েনি। একদিনের ছুটি নিয়ে রেখে আসবে কথা দিলেন অফিসে।
ধীরে ধীরে সময় হলো প্লেন উড়ে যায় ওপরে। প্রথম একটু ধড়ফড় করছিল বুকের ভেতর। কিন্তু ওড়া শুরু হলে সমস্ত ভয় কাটিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম যাত্রা শেষ পর্যন্ত। বেশ ভালো লাগলো কিন্তু আকাশ ধরা আর হলো না। কারণ ওপর থেকে অনেক্ষন নিচের দিকে বাড়ি, রাস্তা, পুকুর, নদী দেখতে পেয়েছি। ধীরে ধীরে ছোটো ছোটো স্বপ্নগুলো ভেসে যাওয়া মেঘের সাথে মিশে গেছে। একসময় নামতে শুরু করলো প্লেন। তখন মনে হচ্ছে নাগরদোলায় বসে আছি।
ছেলের কাছে পৌঁছে গেলাম হসপিটালে। দেখলাম ছেলের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম কি হয়েছে এমন করে কাঁদছিস কেন? ছেলে ঠোঁট ফুলিয়ে বলতে থাকে- মা বাড়ি যাবো। দেখো কত সেলাইন চলছে, হাত ফুলে উঠেছে। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম- বড় হয়েছো বাবা, এমন করে কাঁদছিস কেন। অসুখ হয়েছে সুস্থ হতে হবে তো। আমি তো এসে গেছি। আর মন খারাপ করেনা। দিন কয়েক পরেই ছাড়া পেলো। ও ভীষণ খুশি বাড়িতে যাবে। তবে কলকাতা নয় মুম্বাইয়ে যেখানে উঠেছে।
একটু সুস্থ করে তোলার পর আমার ও সময় শেষ হয়ে গেল। ছেলে মুম্বাইয়ে থেকে প্লেনের টিকিট কেটে আমাকে একা উড়িয়ে দিয়ে বললো- “মা আজ তোমার স্বপ্ন পূরণ হলো?” বুকের ভেতর কষ্টটা চেপে ধরলো। একা একদম একা আকাশে উড়ে যাবো। ছেলেকে হাসতে হাসতে টা টা দিলাম। বললাম- খুব সাবধানে থেকো, নিজের যত্ন নিও, সময় মতো খাবার খেয়ে নিও, পেট খালি রেখো না। মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিল কেউ যেন মা ছেলের নাড়ীর সম্পর্কটা টেনে হেঁচড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে। কান্না থামাতে পারছিনা আজও। আসতে মন একদম চাইছিল না। কিন্তু মেনে নিতে বাধ্য হলাম মেয়েদের জীবনে নিজস্বতা নেই। তাই কারো ভরসায় চলতে হবে।।