শ্যামসুন্দর ঘোষ,পূর্বস্থলী ও মেমারি(পূর্ব বর্ধমান),০৫ নভেম্বর : জন্ম মামার বাড়িতেই । শৈশবের দিনগুলো কেটেছিল ঠাকুরদা, ঠাকুমা, মামা, মামির স্নেহছায়ায় । এমনকি প্রাথমিক শিক্ষা মামার বাড়ি গ্রামের স্কুলেই । রয়েছে অনেক বন্ধুবান্ধব । বন্ধুদের সঙ্গে গাছের আম,জাম,বেল পেড়ে খাওয়া থেকে শুরু করে গ্রামের দিঘিতে দাপিয়ে বেড়ানোর স্মৃতি কখনও ভুলতে পারেননি প্রয়াত পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় । তাই মন্ত্রী হওয়ার পড়েও বারবার ছুটে গেছেন মামার বাড়ি পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি-২ ব্লকের বড়পলাশন-১ অঞ্চলের মন্ডলগ্রামে । তাঁর হাত ধরেই উন্নয়নের স্বাদ পেয়েছেন মন্ডলগ্রামবাসী । রাস্তাঘাট পাকা করা থেকে পানীয় জলের ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন সুব্রতবাবু । কথা দিয়েছিলেন এলাকার মানুষের সুবিধার্থে একটা হাসপাতাল নির্মান করে দেবেন । কিন্তু অপূর্ণ থেকে গেল তাঁর এই স্বপ্ন । তার আগেই তিনি চলে গেলেন চির ঘুমের দেশে । বৃহস্পতিবার রাতে বৈদুতিন মাধ্যমে এই খবর পেতেই শোকের ছায়া নেমে আসে মন্ডলগ্রাম জুড়ে ।
মামার বাড়ি থেকে ২৫-২৭ কিমি দূরে পূর্বস্থলী-১ ব্লকের নাদনঘাট থানার অন্তর্গত ন’পাড়ায় পৈতৃক বাড়ি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের । বাবা অশোকনাথ মুখোপাধ্যায় নাদনঘাট রামপুরিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন । মা সাবিত্রী দেবী গৃহবধূ । বৃহস্পতিবার দীপাবলির রাতে এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুব্রতবাবুর মৃত্যুর খবর আসতেই মণ্ডলগ্রামের পাশাপাশি শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে ন’পাড়া গ্রামও । শুক্রবার সকালে সুব্রতবাবুর পৈতৃক ভিটেতে গিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে যান রাজ্যের মন্ত্রী তথা পূর্বস্থলী-১ বিধায়ক স্বপন দেবনাথ ।
স্বপনবাবু বলেন, ‘সুব্রতদা আমাদের এলাকার ন’পাড়ার গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন । উনি যখন ছাত্র পরিষদের নেতা ছিলেন আমি তখন নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র । তিনি নবদ্বীপ বহু বার এসেছেন । তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমাদের । সুব্রতদাকে নিয়ে আমাদের গর্ব হত । গোটা গ্রাম আজ শোকস্তব্ধ । আমরা তাঁর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি । এলাকাবাসীদের সঙ্গে আমি সুব্রতদার স্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে গভীরভাবে সমবেদনা জানাই । দাহ কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা এখানে স্মরণসভা করব ।সুব্রতদার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আমরা বিভিন্ন পরিকল্পনা করব ।’
পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘সুব্রতদা জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী থাকার সময় ন’পাড়া, মন্ডলগ্রামে অনেক উন্নয়ন করে গিয়েছিলেন । নাদনঘাটসহ এলাকার মানুষ একজন অবিভাবককে হারালো । পঞ্চায়েত দপ্তরের কোনও কাজ আটকে গেলে আমি সুব্রতদার কাছে যেতাম । দাবি জানাতাম ৷ আমি একজন দাদাকে হারালাম । একজন কর্মী মানুষকে হারালাম ।’
এদিন দেখা গেল মন্ডলগ্রামে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মামার বাড়িতে শোকের ছায়া । যে ঘরে সুব্রতবাবুর জন্ম হয়েছিল সেই ঘরের দাওয়ায় বসে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করছেন তাঁর ছোটবেলার সঙ্গীসাথী ও মামার বাড়ির লোকজন । সুব্রতবাবুর মামাতো ভাই সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সুব্রতদা অসুস্থ হলেই ওনার মা সাবিত্রীদেবী ন’পাড়া থেকে দাদাকে কোলে করে পায়ে হেঁটে মন্ডলগ্রামে আসতেন । মন্ডলগ্রামের মা রক্ষাকালীর কাছে মানত করতেন । মায়ের চরণামৃত পান করিয়ে ও মাদুলি পড়িয়ে দিলে সুব্রতদা সুস্থ হয়ে উঠতেন ।’ তিনি বলেন, ‘দাদা গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারী শেষ বারের মত মন্ডলগ্রামে এসেছিলেন । ওইদিন মণ্ডলগ্রাম ভড়ার পাড় থেকে মা জগৎগৌরী বাড়ি পর্যন্ত একটি রাস্তার উদ্বোধন হয় । সুব্রতদার চেষ্টাতেই রাস্তাটি পাকা হয় । তার আগে রাস্তাটি কাঁচা ছিল । তাই গ্রামবাসীদের দাবিমত রাস্তাটি সুব্রতদার মায়ের নামে নামকরন করা হয় ।’
সুব্রতবাবুর বন্ধু তথা মণ্ডলগ্রামের বাসিন্দা সুকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সুব্রত আমার ছোটবেলার খেলার সাথি ছিল । আমরা এগাছে ওগাছে উঠে কত লাফালাফি করেছি । কখনও গ্রামের দিঘিতে সারা দুপুর সাঁতার কেটেছি । সুব্রত সিড়ির নাড়ুর খেতে খুব ভালোবাসতো । সেই সময় গ্রামে অভয় দাস নামে একজনের দোকান ছিল । ওর দোকান থেকে লুকিয়ে নাড়ু নিয়ে পালাতো সুব্রত ।’ এরপরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সুকুমারবাবু ।
মণ্ডলগ্রামবাসী বাবু চৌধুরী,মামাতো ভাই সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়রা বলেন, ‘সুব্রতদা গ্রামে এলেই উনি যে ঘরে জন্মেছিলেন সেখানে প্রথম যেতেন । ওই ঘরের দাওয়াতে বসে বন্ধুবান্ধব গ্রামবাসীদের সঙ্গে বসে গ্রামের উন্নয়নের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হত । উনি গ্রামের প্রভুত উন্নয়ন করেছেন । রাস্তাঘাট ছাড়াও পানীয় জলের ব্যাবস্থাও করে দিয়েছেন । তবে চেয়েছিলেন এলাকাবাসীর সুবিধার্থে একটা হাসপাতাল নির্মান করতে । কিন্তু ওনার সেই স্বপ্ন পূর্ণ হল না । তার আগেই আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন ।’ তাঁরা বলেন, ‘মণ্ডলগ্রামের রক্ষাকালীকে খুব বিশ্বাস করতেন সুব্রতদা । উনি যখন থেকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তখন থেকেই আমরা ওনার সুস্থতা কামনায় রক্ষাকালীকে পূজো দিয়েছি । বৃহস্পতিবারও ঢাকঢোল বাজিয়ে মায়ের পূজো দিয়েছিলাম । কিন্তু মা আমাদের প্রার্থনা শুনলেন না । আমরা একজন অবিভাবককে হারালাম ।’।