সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হ্যারিকেনের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। পৌষ মাস, প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে। মনে হচ্ছে বরফ গলে গলে পড়ছে। কমলা দেবী ভুবন কে নিয়ে মোটা কাঁথা মুড়িয়ে বসে রয়েছে।
এমন সময় হারাধন মাঝি নৌকাখানা ঘাটে বেঁধে অন্ধকারে ঠক ঠক করে বাড়ির মধ্যে এসে, “কি’গো ঘুমিয়ে পড়লে বুঝি? আলো খানা নিয়া একবার সামনে আসো দেখিনি”!
কমলা দেবী হ্যারিকেনটা নিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলতে যাচ্ছে আর বলছে, ” আজ এতো রাইত করলে যে! ক্যারায়া বেশি হইছে বুঝি”! এই বলে তাকিয়ে দেখে হারাধন মাঝির পাশে মধ্যবয়সী একজন নারী।
কমলা দেবী: ‘হ্যাঁ’গো এ কাকে নিয়া আসলে গো! আমার কপাল খানা বুঝি পুড়লো এইবার! মা’গো-মা এই বয়সে আমার সতীনের ঘর করতে হইবে’!
হারাধন মাঝি: ‘একটু থামো দেখিনি! আমার কতাখান একবার শোনো। মাইয়াডারে গরে লইয়া যাও দেখিনি।
কমলা দেবী: ‘ হ্যা’গো মাইয়া তোমারে কইতেছি, তুমি আমার স্বামীরে কাইরা নেলা। আমার ছাওয়ালডার কতা একবার ভাবলা না। আমার এতো বড় সর্বনাশ খান কেমনে করলা’?মেয়েটি বলে উঠলো, ‘আমাকে একটু ঘরে ঢুকতে দিন। আর যদি সম্ভব হয় একটা শুকনো কাপড় দেবেন’।
কমলা দেবী চোখের জল মুছে, ভালো করে তাকিয়ে দেখে মেয়েটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব ভিজে টুপ-টুপ করছে। কমলা দেবীর মনে কোথাও একটু দয়া হলো। একখানা সুতির কাপড় দিয়ে বললো, ‘নাও ভিজা কাপড় খান ছাইড়া লও’।
চারিদিকে ধু-ধু অন্ধকার ঘরে একটাই হ্যারিকেন। মেয়েটি কাপড় পরিবর্তন করছে আর কমলা দেবী হ্যারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মেয়েটি সুঠাম দেহের অধিকারী। প্রায় ৫ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল।
কমলা দেবী মনে মনে ভাবছে, এত সুন্দর একটা মাইয়া কি কইরা আইলো আমার বুড়ো মাঝির লগে!
হারাধন মাঝি: ‘কি’গো হইলো তোমাগো? বড্ড খিদা পাইছে। কমলা দেবী ফিস ফিস করে বলে উঠলো, ‘যেটুকো ভাত আছে তাতে তো চাইর জনের হইবে না’!
হারাধন মাঝি: একটু কম কইরা ভাগ কইরা দাও দেখিনি।
মেয়েটি: আমি কিছু খাব না। আমাকে এক গ্লাস জল দিলেই হবে।
হারাধন মাঝি: সে কেমন কতা! তুমি খাইবা না? আসো আসো খাইয়া লও।
খেতে বসে মেয়েটি থর-থর করে কাঁপছে। কমলা দেবী গায়ের চাদরখানা ছুড়ে দিয়ে বললো, ‘ক্যান আইচো এই হানে কষ্ট করতে? আমাগো নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
আর আপনারে কইতেছি, এই কাঁচা বয়সী মাইয়াডারে ক্যান লইয়া আইছেন? আমাগো অর্ধেক দিন হাড়ি চড়ে না’। খাওয়া শেষ করে ভুবন শুয়ে পড়লো।
হারাধন মাঝি: ‘কই’গো আমার ছিলুম খান সাজাইয়া দাও দেখিনি’!
হারাধন মাঝির সারাদিন কাজকর্ম করে রাতে এক ঘন্টা ছিলুম না টানলে ঘুম হয় না।
কমলা দেবী কল্কির মধ্যে তামাক ও আগুন দিয়ে ছিলুম সাজিয়ে হারাধন মাঝির হাতে দিয়ে বলল, আমারে ক্যান কইতেছেন? যারে লইয়া আইছেন তারে কইতে পারেন না’!
হারাধন মাঝি, ছিলুমে ভট-ভট করে দুটো টান দিয়ে, ভুবনের মা, তুমি আমারে শুদাই ভুল ভাবলা! আর একটু দেরি হইলে ওই মাইয়াডারে জীবিত অবস্থায় পাইতাম না’।
কমলা দেবী: এই সব কি কইতেছেন আপনি?
মেয়েটা: আমি বলছি, আমি অনুপমা। একজন রিপোর্টার। বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর সংগ্রহ করে প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেই এবং যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করি।
আজ সুলতানের আড্ডা খানায় প্রবেশ করেছিলাম। সুলতান তার দলবল নিয়ে যেভাবে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে, এইভাবে চলতে থাকলে এলাকাটা ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধু এই এলাকাই নয় ওর শিকড় ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আনাচে-কানাচে। গ্রামের প্রতিটা যুবতী মেয়ে সুলতানের খাবারের সামগ্রী হচ্ছে।
সবাই নিজের জীবনের ভয়ে অন্যায় মেনে চলছে। কিন্তু ওকে’তো এভাবে বাড়তে দেয়া যায় না। আজ আমিও সুলতানের শিকার হতে যাচ্ছিলাম। কোনভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ি। ভেবেছিলাম সুলতান আমাকে ছিড়ে খাবার আগে নদীতে ডুবে মরা অনেক ভালো।
হারাধন মাঝি: আমি ক্যারায়া বাইয়া বাড়ির দিকে আইতেছি এমন সময় দেহি কেউ একজন নদীতে ডুইবা যাইতেছে। আমি নদীতে ঝাপাইয়া পরি। কোন ভাবে মাইয়াডারে নৌকায় তুলি। মনে করছিলাম হয়তো মইরাই গ্যাছে। মা’তারার কৃপায় মাইয়াডার কিছু হয়নায়।
কমলা দেবী: আমি কতো ভুল ভাবছালাম গো! অনেক কতা কইয়া ফেলাইছি। আমারে ক্ষমা কইরা দাও।
অনুপমা : আপনি ঠিকই করেছেন আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সেও একই কাজ করতো।
হারাধন মাঝি : তোমার বাড়ির ঠিকানা খান কও দেখিনি। রাইত থাকতে থাকতে নৌকা ছাড়তে হইবে। উজান বাইয়া আবার যাওয়া যাইবে না।
অনুপমা : আমি এখানে দুটো দিন থাকতে চাই। সুলতানের সমস্ত শিকড় মূল থেকে তুলে প্রশাসনের হাতে তুলে দিয়ে ওকে যথাযোগ্য শাস্তি দিতে চাই।
কমলা দেবী: তুমি ঠিকই কইছো। আমিও তোমার লগে থাকবো। তোমারে সাহায্য করবো। আর কতো মা বোনের ইজ্জত নিয়া খেলবে সুলতান!
হারাধন মাঝি: আমিও আছি তোমাগো লগে।
অনুপমা : আগামী সূর্যোদয়ে শুরু হবে আমাদের সুলতান নির্মূলের অভিযান।।