গ্রামের নাম পোড়াপাড়া। কেন যে এমন নাম গাঁয়ের বয়স্করাও কেউ বলতে পারে না। গাঁয়ের এক পাশে প্রাইমারী স্কুল। ওখানেই লেখা – পোড়াপাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর এপাশে ত্রিফলা একটা লোহার খুঁটি পোঁতা, পঞ্চায়েত থেকে বসানো ছিলো। এটা পোড়াপাড়া বাস স্টপেজ। আর কোথাও গাঁয়ের নাম লেখা নেই। হালে পাকা রাস্তা হয়েছে গাঁয়ের মাঝখান দিয়ে। তিন চারটে বাস চলে সারাদিন।
বাসস্টপের কাছেই চঞ্চলের পান গুমটি। পান, সিগারেট, আর কিছু মনিহারী জিনিস পত্র দিয়ে সাজানো চঞ্চলের দোকান। মোটামুটি চলে যায়। সামান্য চাষের জমি, আর দোকানের আয়, টুকটাক মজুরও খাটে সময় পেলে।
জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনে, তাই দিয়ে জ্বালানি। এটা শ্রাবণ মাস, ধান রোয়ার কাজে চঞ্চল এখন দূরের গ্রামে কাজ করতে যায়। ফলে জঙ্গলে যাওয়ার সময় পায় না। বউ’টা কিছুক্ষণ দোকানটা খোলে। দুপুরে বন্ধ করে বাড়িতে যায়। রান্নাবান্না অন্য কাজকর্ম সারে। দুপুরে ওই খাওয়ার সময়টুকু দুজনের দুদণ্ড কথা বলার সময়। বিকেলে চঞ্চল নিজে বসে দোকানে।
সেদিন সাত পাঁচ ভাবছে- কাঠ তো বাড়ন্ত, রান্না হবে কি করে? ভাবল পুরোন স্টোভটায় কেরোসিন ঢেলে কোন রকম রান্নাটা সেরে নিই। বিপদ বোধ হয় ওৎ পেতে ছিল ওদের সুখের ঘরে।
হঠাৎ স্টোভটা বিকট আওয়াজ করে ফেটে যায়। আগুন ধরে যায় সিল্কের কাপড়ে। ধোঁয়া আর ধোঁয়া চারিপাশে। লোকজন আসতে আসতে বেশির ভাগ পুড়ে যায়।
চঞ্চল খবর পেয়ে ছুটে আসে হন্তদন্ত হয়ে। পুরো শরীরটা প্রায় পুড়ে শেষ হয়ে গেছে …
অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করার কথা কিন্তু নিশ্চুপ হয়ে পড়ে আছে বউটা। চেনার উপায় নেই, কাছে গিয়ে হতটা ধরে চঞ্চল, চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে পোড়া বুকে। কিছুক্ষণ আগেই যাকে আহ্লাদ করে আদরে আদরে ভরিয়ে ছিল সেই পোড়া বুক এখন দগদগে লাল। খুব ভালোবাসত দুজন দুজনকে।
চঞ্চল ওর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নীরবে কেঁদে চলেছে। কি থেকে কি হয়ে গেল! একদৃষ্টে বউয়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে সে, যেন কতকাল দেখেনি।
আগুনের দহন শক্তির নিষ্ঠুরতার মাঝেও পোড়া হাত পা শরীর তাকে ডাকছে। ‘কি গো… কি দেখছ অমন করে’? কাছে আসতে ভয় পাচ্ছ ? আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরবে না, গতকাল রাতে যেমন করে জড়িয়ে ধরে সোহাগ করলে সারারাত।
এতদিন যেমন করে আদর করেছ, ভালবেসেছ ? তোমার বুকের মাঝে শিশুর মত জড়িয়ে ধরেছ, পুতুলের মত সাজিয়ে রেখেছ! আমিও নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম তোমার কাছে। আজ বড় ইচ্ছে করছে গো.. এস না !
চঞ্চল বহু কষ্টে নিজেকে সামলে তার হাত দুটো নিজের হাতে নিল। কেউ তো কোন অপরাধ করিনি, তাহলে এমন স্থায়ী বিরহের বোঝা কেন চাপলো! হে ঈশ্বর ! কত নিষ্ঠুর তোমার পরিহাস।চঞ্চল বউয়ের হাত দুটো আর কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। তবুও পুলিশ এসে হাতকড়া পরায় বউয়ের হাতে হাত ধরা চঞ্চলের দুহাতে, বধূ হত্যার অপরাধে।।