ইলেভেনের ক্লাস সবে শুরু হ’ল।
ক্লাস চলাকালীন কথা বলা বারণ জেনেও মিতালী আজ নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারল না। প্রবল উত্তেজনায় তিয়াসার কানের পাশে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,এই তিয়াসা, জানিস, কাল শৈবালকে মেঘলার সঙ্গে মেলায় ঘুরতে দেখলাম। দু’জনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে কথা বলছিল। কেসটা কী রে? তোর সঙ্গে শৈবালের ব্রেকআপ হয়ে গেছে নাকি?
বায়োলজি ক্লাস চলছিল তখন। হিমাংশু স্যারের ক্লাস খুব মনোযোগ দিয়ে তিয়াসা শুনছিল, কারণ বায়োলজি তার প্রিয় সাবজেক্ট। তার উপর হিমাংশু স্যারের ক্লাস বলে কথা। হঠাৎ মিতালীর কথায় তিয়াসার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একরাশ বিরক্তি নিয়ে মিতালীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে, মিতালী, কী হচ্ছে এসব? ক্লাসের মাঝে কথা বলছিস? আর এসব কথা এখন না বললে হত না?! আস্তে করে রাগান্বিত স্বরে মিতালীকে বলল তিয়াসা।
— আরে কী মুশকিল! হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল বলেই তো বললাম!
মিতালীর চাপা স্বরে তখন ক্ষোভ ঝরে পড়ল।
মিতালীকে রাগ দেখালেও তিয়াসা মনে মনে কিছুটা বিচলিত হ’ল।
গতকাল শৈবাল তাকে বলেছিল ওর মামার বাড়িতে যাবে, তাই সন্ধ্যেবেলায় ওর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। তবে কি শৈবাল তাকে মিথ্যে কথা বলল?
না, শৈবাল কিছুতেই মিথ্যে বলতে পারে না তাকে। হয়ত মিতালী ইচ্ছে করেই এসব বানিয়ে বলছে। হিংসুটে মেয়ে একটা! কিছুদিন আগেও শৈবালের পিছনে খুব ছুকছুক করছিল, পাত্তা পায়নি বলে ওদের ভালো সম্পর্কটা ভাঙার চেষ্টা করছে।
মনে মনে বলল তিয়াসা।
তারপর মিতালীর উদ্দেশ্যে বলল — চুপ কর, ক্লাস করতে দে এখন।
তিয়াসার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে যথারীতি অবাক হয়ে মিতালী আবার বলল– তুই কী রে, তোর প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে অন্য একজন টানাটানি করছে আর তুই কিনা এমন বিকারহীন হয়ে রইলি!
— সে তো তুইও একদিন করেছিলি, থাম এখন।
আচমকা এভাবে আঘাত পাবে সেটা আশা করেনি মিতালী।
ক্ষুণ্ন হয়ে মিতালী বলল,
— এরজন্যই অন্যের ভালো করতে নেই।
— তোকে আমার ভালো – মন্দের কথা ভাবতে হবে না। ক্লাসটা কর মন দিয়ে, আমাকেও করতে দে।
তিয়াসা একটু জোরেই বলল কথাটা।
— তিয়াসা!!
হিমাংশু স্যারের গর্জন শুনে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল তিয়াসা।
— কথা বলার থাকলে, তোমরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও।
— সরি স্যার।
— আর যেন কথা বলতে না শুনি, নইলে আমিই ক্লাস ছেড়ে চলে যাব।
রাগে অপমানে তিয়াসার দু’চোখ ছলছল করে উঠল।
ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল তিয়াসা। তাই অনেকেই ওর জায়গা নেওয়ার চেষ্টায় নানা রকমভাবে উস্কায়, সেটা তিয়াসা এতদিনে ভালোই জেনে গেছে। আজ মিতালীর কথায় সাড়া দেওয়া তার একদমই উচিৎ হয়নি। মনে মনে নিজেকেই দোষারূপ করল তিয়াসা।
— sit down!
হিমাংশু স্যারের কথায় নতমুখে মিতালীর কাছ থেকে সরে, বেঞ্চের একেবারে কোণায় গিয়ে বসল। তিয়াসার এই উপেক্ষায় অপমানিত হয়ে মিতালী মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও আর কোন কথা না বলে সেও ক্লাসে মন দেয়।
স্কুল ছুটির পর, শৈবাল রোজকার মত আজও গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে তিয়াসার জন্য। সবার শেষে স্কুল থেকে বেরোয়, এটাই ওর স্বভাব। তারপর দু’জনে একসঙ্গে গল্প করতে করতে যে যার বাড়ি ফেরে। ছোট থেকেই একসঙ্গে পড়ে ওরা। তাই এতদিনে ওদের মধ্যে বন্ধুত্বও বেশ বেড়েছে। এখন দু’জনের মধ্যে অভিমান এবং অধিকারবোধও জন্মেছে। তবে তিয়াসা বরাবরই চাপা স্বভাবের। তাই শৈবাল ওকে অনেকসময় বুঝতে পারে না। ক্লাসে কোন পজিশন না থাকলেও শৈবালও মেধাবী। ওদের মধ্যে নোটস আদান-প্রদান প্রায় রোজই চলে।
তিয়াসাকে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে শৈবাল এগিয়ে যায়।
— আজ অতিরিক্ত দেরি করে ফেললি, ব্যাপার কী?
— হিমাংশু স্যারের সঙ্গে কথা বলছিলাম।
— আবার ওই তোর আশিক স্যার!!
— শৈবাল!
শান্ত ধমকের সুরে তিয়াসা বলল।
— আচ্ছা ঠিক আছে বলব না। তবে ওই হিমাংশু স্যারের কিন্তু তোর প্রতি বেশ দুর্বলতা আছে বলে আমার মনে হয়।
এগিয়ে যেতে যেতে হাসিমুখে বলে শৈবাল।
— ভালোই তো।
— ভালো!!
— কী অন্যায় শুনি? স্টুডেন্ট – স্যারের সম্পর্ক একটা ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকাটাই তো উচিৎ!
অন্যদিন হলে এমন কথা কখনও বলত না তিয়াসা। তবে আজ মিতালীর কথা শোনার পর থেকেই শৈবালের উপর চাপা একটা রাগ জন্মেছে। গতকাল মামার বাড়ি যাবে বলে সেখানে না গিয়ে মেলায়… কেন মিথ্যে বলল, সেটাই আসল কারণ।
— কী! ? ভালোবাসা?!
— হ্যাঁ! আমার খুব ভালো লাগে হিমাংশু স্যারকে। কত হ্যান্ডসম বল!
এই কথা শুনে শৈবাল মনে মনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। ঝট করে তিয়াসার মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ায় শৈবাল। রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে বলে ,
— আরেকবার বল দেখি!
তুই তাহলে আমার সঙ্গে এটা কী করছিস? শুধু বন্ধু আমরা? সত্যি করে বল!
— হ্যাঁ, তুই আমার শুধুই বন্ধু। বন্ধুর প্রতি যেমন ভালোবাসা থাকে সেটাই আমাদের মধ্যে আছে। এর বেশি আর কী থাকবে?
শৈবালের চোখে চোখ রেখে দৃঢ়স্বরে বলল তিয়াসা।
তারপর আবার বলল,
— যেতে দে আমায়। আমিও আজ মামার বাড়ি যাব।
মামার বাড়ির নাম শুনে শৈবালের মুখ তৎক্ষণাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিয়াসা সেটা লক্ষ্য করল।
শৈবাল আমতা আমতা করে বলল,
— তুই তো আগে বলিসনি আজ মামার বাড়ি যাবি! আজ সন্ধ্যেবেলায় দেখা করব বলেছিলাম!
— সব কথা কি বলতে হবে তোকে? না, আমি আজ পারব না মিট করতে। তিয়াসার
কণ্ঠের তিক্ততা শৈবালকে বিদ্ধ করল।
তারপর চলতে চলতে শান্ত স্বরে শৈবাল বলল,
— ঠিক আছে। তুই এগিয়ে যা। আমি একটু অন্য কাজ করে বাড়ি ফিরছি।
— ঠিক আছে।
এই বলে দু’জনে দু’দিকে এগিয়ে গেল।
— তিয়াসা !
বাগানে বসে কখন যে বর্তমানের গণ্ডি ছাড়িয়ে সময়ের পাঁচিল টপকে কিশোরীবেলায় পৌঁছে গেছিল বুঝতেই পারেনি।
পিছন থেকে কারও ডাকে ভাবনার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘুরে তাকাল তিয়াসা।
চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চোখে মুখে তার বিস্ময় রেখা ফুটে উঠেছে।
— আরে, তুমি ! কখন এলে? বলোনি তো আজ আসছ!
— সারপ্রাইজ!! কেমন লাগল বল!
— ভারী অদ্ভুত তো ! আমি যদি বাড়িতে না থাকতাম?
— খুঁজে নিতাম। জানি তো কোথায় কোথায় যেতে পারো!
— তোমার এই স্বভাব বদলাও অংশু!
কিঞ্চিৎ অভিমানের সুরে উত্তর দিল তিয়াসা।
আগামীকাল বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্ণ হবে তিয়াসা আর হিমাংশু রক্ষিতের। বিগত দু ‘ বছর ধরে ওরা দু’জনে সেপারেশন হয়ে গেলেও প্রতিবছর এই দিনটি একসঙ্গে সেলিব্রেট করে।
— তুমি যে আজ আমার কাছে এলে, ঋত্বিকা জানে ?
হিমাংশু সামনের বেতের চেয়ারে বসে মাথাটা পিছন দিকে হেলিয়ে চোখটা বন্ধ করে দিয়ে বলে,
— নিজের সব কথা আমি কখনও কারও সঙ্গেই share করি না। সেটা তো তুমি ভালোভাবেই জানো তিয়াসা!
— সে আমিও। তাই তো আজ আমরা নিজের মত করেই ভালো থাকার চেষ্টা করছি।
কথাটা বলতে বলতেই
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তিয়াসার।
— কাছে এসে একটু বসো না!
আবেগী স্বরে হিমাংশু বলল।
— দাঁড়াও, আগে আমি তোমার জন্য কফি করে আনছি।
তিয়াসা বলল।
— আরে একটু বসো না এখানে।
— তুমি এখন আর আমার হাসব্যান্ড নও অংশু!
— তাতে কী? বন্ধু তো!
— সে ঠিক। এই বন্ধুত্বটাই থাক বরং।
— তার জোরেই তো বসতে বলছি। তোমার শরীর ছুঁতে চাইনি তো! সান্নিধ্য চেয়েছি মাত্র।
— বাজে কথা বলো না অংশু।
— সত্যিই বলছি, আমি ছোঁব না তোমাকে।
— আমাদের মধ্যে একটা দূরত্ব থাকা উচিৎ।
— সে তো এতদিন ধরে মেনেই চলেছি। সীমারেখা অতিক্রম করিনি। আজ একটু কাছে এসে বসো না!
হিমাংশুর অনুরোধে তিয়াসা তার পাশে গিয়ে বসতে বসতে বলল,
— অংশু, নীলাদ্রির ব্যাপারে কিছু বলার ছিল। ছেলে তো এবার দেশে ফিরছে, ওর সঙ্গে সমৃদ্ধিও ফিরছে। ওদের এবার বিয়েটা দিতে বলা হবে, বুঝলে?
— কেন? ওরা তো লিভ ইন এ বেশ আছে , অযথা কমপ্লিকেটেড করতে চাইছ কেন তুমি?
— এভাবে কি সারাজীবন থাকবে? একটা নাম হবে না এই সম্পর্কের?
— তিয়াসা! তুমি এমন কথা বলছ! যে কিনা নিজেই …
— কী নিজেই? বলো! আমাদের আলাদা হওয়ার একটা কারণ ছিল। সেটা ভুলে যেও না তুমি।
তিয়াসার কণ্ঠে বিরক্তি।
— আছে মনে। তবে আমি কিন্তু ডিভোর্স চাইনি!
— তুমি অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলে অংশু! সেটা মিথ্যে ছিল?
— তিয়াসা, আমি কিন্তু তোমাকেও ভালোবাসতাম এবং আজও বাসি।
মুখের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি এনে তিয়াসা বলল,
— ভালোবাসা?! না কি শরীর চেয়েছ শুধু? সেটা আর আলাদা করে আমাকে বোঝাতে হবে না অংশু!
— কী আর বলব বলো!?
— তুমি ঘরে এসো। আমি যাচ্ছি ভিতরে।
তিয়াসা চলে যেতে চাইলেই তার হাত ধরে টেনে নিজের পাশে আবার বসিয়ে দেয় হিমাংশু।
দু’হাতে তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— বলো একটা সত্যি কথা, আমাকে তুমি ভালোবাসো না? আমাকে ভুলে কি তুমি থাকতে পারো?
— ছাড় তো! বুড়ো বয়সে এই হ্যাংলামো ভালো লাগে না আমার।
— আমি বুড়ো? দেখাব কতটা বুড়ো?
বলতে বলতে তিয়াসাকে জোর করে বুকের কাছে টেনে ধরে।
— ছাড় অংশু।
একরাশ বিরক্তিতে অংশুর বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে তিয়াসা উঠে দাঁড়ায়।
— ভিতরে এসো। বাইরে হিম পড়া শুরু হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা লাগবে তোমার।
অনেকদিন পর এমন উষ্ণতা মাখানো কণ্ঠে অংশু এক মুহুর্ত আবেগী হয়ে এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— এমন করে বলো না টিয়া, বড্ড কষ্ট হয়। এই জায়গাটা আবার উস্কে দিও না।
ছলছল হয়ে এল হিমাংশুর দু’চোখ।
— বেশ , এসো।
গম্ভীর কণ্ঠে তিয়াসা বলে।
সবুজে ঘেরা লন থেকে কিছুটা দূরে বাড়ির দিকে
দু’ জনে একসঙ্গে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। (ক্রমশঃ)