হিমাংশু বেরিয়ে যেতেই তিয়াসা ঝটপট ঘরদোর গুছিয়ে নিল। কাজের মেয়েটার আসার সময় হয়ে গেছে। তাই সদর দরজাটা খোলা রেখেই বাইরের ঘরে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সোফায় বসল। আজকের এই বিশেষ দিনটা বারবার অতীতে ফিরে নিয়ে যায় তিয়াসাকে।
অন্যদের বিবাহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল ওদের বিয়ে। না ছিল কোন আড়ম্বর, না ছিল কোন আত্মীয় এবং অতিথির সমাহার।
টুয়েলভের পরীক্ষা হতে তখন প্রায় মাসখানেক বাকি। শৈবাল আজকাল আর আগের মত কথা বলে না তিয়াসার সঙ্গে। তিয়াসাও নিজে থেকে যেচে কথা বলতে যায়নি।
পরীক্ষার প্রস্তুতির খোঁজ নিতে একদিন হিমাংশু স্যার ফোন করে তিয়াসাকে। সঙ্গে এটা বলেন কিছু অসুবিধে হলে বিনা দ্বিধায় যেন ওঁর কোয়ার্টারে চলে আসে। কারণ ওর রেজাল্টের দিকে গোটা স্কুল আশার পথ চেয়ে আছে। তিয়াসাও জানে ওকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কাকা – কাকিমার গলগ্রহ হয়ে আর কতদিন থাকবে? মা- বাবা তো অনেকদিন আগেই ইহসংসারের মায়া ছেড়ে পরলোক গমন করেছেন। মাতৃপিতৃহীন অনাথ মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন যাঁরা, মাঝে মধ্যে তাঁরা দু’একটা কটুকথা শোনান না বললে ভুল হবে, তবে তিয়াসা মনে করে, তাঁরা বলতেই পারেন, কারণ সে তাঁদের আশ্রিতা। তাই সব কষ্টই মুখ বুজে সহ্য করে।
হিমাংশু স্যারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে একটা অধ্যায় বোঝার জন্য এক বিকেলে স্যারের বাড়িতে যায় তিয়াসা। বাড়িতে জানিয়ে যায় মিতালীকে সঙ্গে নিয়ে হিমাংশু স্যারের বাড়িতে যাচ্ছে। কারণ এটা না বললে ব্যাচেলর হিমাংশু স্যারের বাড়িতে যেতে দেবে না ওর বাড়ির লোকজন। আর মিতালীকে আজকাল সেও এড়িয়ে চলছে; কারণে অকারণে শৈবালের সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করে তাকে বিব্রত করছে। শৈবালের সঙ্গেও তেমন করে যোগাযোগ নেই আর।
তিয়াসা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মিতালী হঠাৎ সেদিনই ওদের বাড়িতে আসে। সে আসতেই ওর মিথ্যে বলে বেরোনোর কথা ধরা পড়ে যায় বাড়ির সকলের সামনে। কাকু – কাকিমা সবাই রেগে আগুন হয় সেদিন। কাকিমার ভয়ংকর ক্রুদ্ধ রূপটা দেখেছিল সে রাতে। ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিল কাকিমা। কাকুও এই কথার কোন প্রতিবাদ করেনি। রাগে , দুঃখে , অপমানে পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাউকে কিছু না বলে তিয়াসা স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। নিজের সঙ্গে আর লড়াই করতে পারছে না। আর বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছে নেই তার। ঠিক সেই সময় সাইকেল চালিয়ে হিমাংশু স্যার সেই পথেই বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। উদভ্রান্তের মত তিয়াসাকে ছুটতে দেখে বিস্মিত হয়ে তার পথ আটকে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল,
— তিয়া….. সা!! কোথায় যাচ্ছ?
হঠাৎ স্যারকে সামনে দেখে থমকে দাঁড়াল তিয়াসা।
তারপর মাথা নিচু করে বলল,
— আমাকে যেতে দিন স্যার!
— আগে বল কোথায় যাচ্ছ? তারপর যেতে দিচ্ছি।
ততক্ষণে তিয়াসার একেবারে সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন হিমাংশু স্যার।
তিয়াসা মুখ তুলতেই, তার দু’চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল।
অবাক হয়ে হিমাংশু বলল,
— কী হয়েছে আমাকে না বললে তোমার পথ ছাড়ব না আমি, বল!
হিমাংশুর স্বরে তখন শাসন, অধিকারবোধ বেরিয়ে এল।
তিয়াসা কাঁদতে কাঁদতে সব বলল।
তিয়াসার সব কথা শোনার পর রাগে হিমাংশুর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
এক মুহূর্ত ভেবে বলে,
— তুমি এখনই আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবে।
— না স্যার। আপনার বা আমার কারও বদনাম হোক সেটা আমি চাই না। প্লিজ, ক্ষমা করুন।
— তিয়াসা, কিসে তুমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে বল? আমি সেটাই করব।
— স্যার, বাড়িতে আপনাকে জড়িয়ে আমাকে খুব ঘৃণ্য কথা শুনতে হয়েছে। এটাকে বাড়তে দেব না আমি। আমি জীবন দিয়ে আপনার সম্মান রক্ষা করব।
— তুমি পাগলামি করো না তিয়াসা। এখন চল আমার সঙ্গে।
একহাতে তিয়াসার হাত ধরে অন্যহাতে সাইকেল টেনে নিয়ে এগিয়ে গেল হিমাংশু।
একটাও কথা না বলে বটতলায় কালীমন্দিরে গিয়ে মা কালীকে সাক্ষী রেখে তিয়াসার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিল হিমাংশু। তারপর বলল,
— আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী। এখন নিজের বাড়ি চল। আজ থেকে আমরা একসঙ্গে থাকব।
বধূবরণ নাই বা হ’ল, উলুধ্বনি – শঙ্খধ্বনি নাই বা কেউ দিল, মনের ভিতরে সেদিন অজান্তেই উঠেছিল শিহরণ, হিমাংশুর প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধায় মনে উঠেছিল প্লাবন, বেজেছিল সপ্তসুরের নীরব ঝংকার।
তিয়াসার হাতের মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠতেই ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। মোবাইল স্ক্রিনে “চম্পা” নাম ভেসে উঠতেই কপাল কুঁচকে উঠল তিয়াসার। কাজের মেয়েটা নিশ্চয়ই আসবে না, তাই ফোনটা করল। মনে মনে বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করল,
— হ্যালো
— দিদিমণি, আমার মেয়ের খুব জ্বর। তাই আজ যেতে পারব না।
— ওহো, কত জ্বর? ডাক্তার দেখিয়েছিস?
— এইবার নিয়ে যাব দিদিমণি।
— ঠিক আছে, দেখিয়ে নে। সব জানাস আমাকে।
— আচ্ছা।
ফোনটা কেটে যেতেই , উঠে বাইরের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে, ব্রেকফাস্ট তৈরি করার জন্য রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল তিয়াসা।(ক্রমশঃ)