দিল্লি এয়ারপোর্টে বাল্যবান্ধবী ঋত্বিকার সঙ্গে দেখা হতেই হিমাংশু জড়িয়ে ধরে একে অপরকে। ছোটবেলায় একই স্কুলে একসঙ্গে পড়ার সঙ্গে পাশাপাশি এক চত্বরে থাকার কারণে দুইজনের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল। স্কুলের পড়া শেষ করে দু’জনই নিজ শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। তারপর থেকেই ওদের দু’জনের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর দীর্ঘ সময় কেটে গেছে, দু’জনেই পড়া শেষ করে চাকরি করছে। কখনও একে অপরকে মনে পড়লেও ফোন নম্বর না থাকাতে কোনরকম যোগাযোগ করার সুযোগ পায়নি।
বেশ ক’দিন আগে ফেসবুক ঘাটতে গিয়ে হিমাংশুকে খুঁজে পায় ঋত্বিকা। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় এবং যথারীতি পুরনো বন্ধুত্ব ফিরে পায় ওরা। একে অপরকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে দুজনেই ভেসে যায় শৈশব – কৈশোরের প্রাঙ্গণে। তারপর ফোন নম্বর আদান প্রদান করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানা কথায়, হাসিতে কাটাতে থাকে।
কিছুদিনের মধ্যেই প্ল্যান করে একই দিনে দিল্লির টিকিট কেটে দু’জনে এয়ারপোর্টে সাক্ষাৎ করে। তারপর দিল্লি থেকে একসঙ্গে হিমাচল যাওয়ার প্ল্যান করে সপ্তাহখানেক ঘুরে আনন্দে কাটিয়ে আসে। বন্ধুত্বের সুন্দর বন্ধন দু’জনকে এক সুঁতোয় বেঁধে দিল আবার নতুন করে।
তবে দুই বন্ধুর এই অমোঘ টান একে অপরের কাছে নিয়ে এল যদিও, অন্যত্র হিমাংশুর দাম্পত্য জীবনে অজান্তেই হাল্কা চির ধরা শুরু করল।
কিছুদিন যাবৎ তিয়াসা লক্ষ্য করছে, সংসারের প্রতি হিমাংশুর টান ক্রমাগত যেন কমছে। স্ত্রী – পুত্রের প্রতি হিমাংশুর এই উদাসীনতাকে লক্ষ করে তিয়াসার মনে জমতে থাকে তীব্র অভিমান এবং সেটা একদিন রূপ নেয় আক্রোশের।
অনুসন্ধান করে আবিষ্কার করে হিমাংশু অন্য এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। কান পেতে ওদের দু’জনের ফোনের কথোপকথন শুনতে থাকে দিনের পর দিন।
একদিন রাতে অতিষ্ট হয়ে রেগে চেঁচিয়ে বলে,
— কার সঙ্গে সারাদিন ফোনে ব্যস্ত থাকছ আজকাল? কে সে? এত কথা আসে কী করে ? ওর সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক ?
তখন ফোনের ওপারে ঋত্বিকা লাইনেই ছিল।
হিমাংশু ফোন না কেটেই বলল,
— এই? তুমি কে বলার? আমি কার সঙ্গে কথা বলব না বলব সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে সব বলতে হবে?
— অবশ্যই বলতে হবে। আমি তোমার স্ত্রী। আমার জানার অধিকার আছে।
— অধিকার! সবার একটা পার্সোনাল স্পেস থাকা দরকার।
— পার্সোনাল?! আমিও তাহলে…
বাক্যটা শেষ না করেই থেমে গেল তিয়াসা।
হিমাংশু ফোনের ওপারে থাকা ঋত্বিকাকে বলল,
— ঋতু, I’ll call back later.
এই বলে ফোনটা কেটে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হিমাংশু।
তারপর গম্ভীর স্বরে বলল,
— টিয়া, তোমার কোথায় প্রবলেম হচ্ছে বল। আমি সলভ আউট করার চেষ্টা করব।
— আমি এই নোংরামো সহ্য করতে পারছি না। I want divorce
— বেশ, তাই হবে।
এই বলে না দাঁড়িয়ে গেস্ট রুমের দিকে চলে যায় হিমাংশু।
হিমাংশুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে অপমানে, রাগে কাঁপতে থাকে তিয়াসা।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ডিভোর্স ফাইল করে হিমাংশু দিল্লি শিফট করে। তিয়াসার কলকাতায় এক কলেজে চাকরি পেতেও কোন অসুবিধে হয়নি । জেদ ,অপমান দুই মিশে তিয়াসার মন তিক্ততায় ভরে উঠেছিল তখন। আর কোন আপত্তি না করে সই করে দিয়েছিল ডিভোর্স পেপারে।
ছেলে বিদেশে থাকায় তাকে তখন কিছু জানায়নি তিয়াসা। পরে জেনে মৌন থেকেছে। কারও স্বপক্ষে – বিপক্ষে কিছুই বলেনি সে। তবে সে বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি কখনও। বাবা – ছেলের সম্পর্ক আগের মতই থেকে গেল।
— চা যে জুড়িয়ে গেল টিয়া!
বাথরুমের দরজায় টোকা দিয়ে বলল হিমাংশু।
এতক্ষণ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে বর্তমান থেকে অতীতের ঘরে প্রবেশ করে ভাবনার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। হিমাংশুর আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেল তিয়াসা।
চটজলদি শাওয়ারটা বন্ধ করে গায়ে টাওয়াল জড়িয়ে উত্তর দিল,
— এই তো হয়ে গেছে।
হাউস কোটটা কোনমতে জড়িয়ে তিয়াসা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হিমাংশু বলল,
— আজ সন্ধ্যেবেলায় একটা ছোট পার্টি রেখেছি। তার আরেঞ্জমেন্ট করতে এখন আমাকে বেরোতে হবে।
— পার্টি! কেন?
— silver jubilee বলে কথা। এই দিন কি আর ফিরে আসবে?
— তবুও … আমি চাই না এই আড়ম্বর।
গম্ভীর হয়ে তিয়াসা বলল।
— এতদিন তোমার চাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। আজ একদিন নাহয়, আমার ইচ্ছেতে বাধা দিও না!
হিমাংশুর দু’চোখে অনুনয়ের ছবি ফুটে উঠল।
তার দিকে তাকিয়ে কাপে চুমুক দিতে দিতে নির্লিপ্ত কণ্ঠে তিয়াসা বলল,
— বেশ , যা ইচ্ছে কর।
খালি কাপ দু’টো ট্রেতে নিয়ে তিয়াসা বেরিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। (ক্রমশঃ)
গল্প : মেঘমালা (পর্ব : ২)