🦋 প্রজাপতিটাকে ধরবার অনেক চেষ্টা করেও রণিত বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। অবশেষে যখন প্রজাপতির পাখাদুটো তার আঙুলের ভাঁজে আটকে গেল একটা একটানা জলতরঙ্গের শব্দ তার মাথার স্নায়ুকোষে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। হাত ফসকে প্রজাপতিটা উড়ে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে। দুত্তোর বলে হাতটা ঝাঁকাতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। সে বুঝতে পারল আওয়াজটা মোবাইল থেকে আসছে। কেউ মেসেঞ্জারে কল করছে।
রাত প্রায় তিনটে পর্যন্ত জেগে থাকার পরে সাতসকালে কেউ যদি কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেয় তাহলে সমস্ত দিনটাই মাটি হয়ে যায়। কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে মোবাইলটা চোখের সামনে ধরতেই তার মেজাজটা এক মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল।
কলটা রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই কৌশানী অপরপ্রান্ত থেকে বলে উঠল, কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম বলে রেগে গেলেন নাকি!
রণিত ঘুম জড়ানো আদুরে গলায় জবাব দিল, একেবারেই না। বরং আজ দিনটা রেড লেটার ডে হয়ে গেল।
সকাল সকাল মিথ্যে কথা বললে ঠাকুর পাপ দেবে।
উমমম. . . একটুও মিথ্যে নয়, তিন সত্যি।
যাকগে ওটা আপনার ভাবনা! বলছিলাম সন্ধ্যাবেলায় ফ্রি আছেন?
রণিতের বুকের ভেতর যেন সহস্র ড্রাম পিটতে শুরু করল। এতদিন সে নানা অছিলায় কৌশানীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও কৌশানী সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। আজ কোনদিকে সূর্য উঠেছিল!
কথা শেষ করে রণিত পর্যবেক্ষণ করে দেখল সাত সকালেই অনেক মেসেজ তার ইনবক্সে ভিড় করে ফেলেছে। এই মুহূর্তে তার একটা মেসেজও পড়তে ইচ্ছে করল না। মনের মধ্যে প্রজাপতিটা আবার উড়াউড়ি শুরু করে দিয়েছে। এবার আর কিছুতেই ছাড়া চলবে না। সে নরম বালিশে আবার মুখ ডুবিয়ে দিল।
কৌশানী পর্ব সেরে রণিত ফ্ল্যাটে ফিরল একেবারে মাতালের মত। সে নিয়মিত ড্রিঙ্ক করে না। অফিস পার্টি বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে বিশেষ কোন সেলিব্রেশন থাকলে একটু আধটু করে। তবে মাতাল হয়না। কিন্তু আজ মদ না খেয়েই সে মাতাল হয়ে গেল! সামনাসামনি কৌশানী আরো বেশি সুন্দরী। তার ঐ মারকাটারি হাসি বুকের বামপাশে একেবারে কাঁচের টুকরোর মতো বিঁধে গিয়েছে। সে তিন চার ঘন্টার জন্য নেট অফ্ করে দিয়েছিল। এখন নেট অন করতেই একেবারে ভেসে গেল।
সবুজ সংকেত দেখেই বনানী কল করল। রণিতের এই মুহূর্তে ভীষণ বিরক্ত লাগল। অন্য সময় হলে হয়তো কলটা রিসিভ করত। কিছু মেয়ে কেন যে এত নাছোড়বান্দা হয় কে জানে! স্ক্রল করতে করতে সমাদৃতার মেসেজে চোখ আটকে গেল।
প্রত্যেকেই তাকে অনেকক্ষন না দেখে নানা ধরনের মেসেজ পাঠিয়েছে। কিন্তু সমাদৃতা সেই সুপ্রভাতেই আটকে আছে! উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত সে একটা কথাও খরচ করবে না! তার এই নাকউঁচু মনোভাবের জন্য রণিতের এক একটা সময়ে এত বিরক্তি লাগে যে এড়িয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন এড়িয়ে থাকতে পারে না। কেন যে পারে না, সেটাই আশ্চর্যের! সমাদৃতাও কিছুদিন পরে সহজ হয়ে যায়। দু’তিনবার ট্রাই করার পরে বনানী হাল ছেড়ে দিল। বনানী পর্ব মিটতে না মিটতেই আবার কল! সেঁজুতি। ছোট্ট মিষ্টি একটা সদ্য কলেজে পড়া মেয়ে। কথার ধার শুনলে মনে হয় কলেজে পড়ায়। একমাস হলো ফেবুতে পরিচয় হয়েছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে তার ভালোই লাগে। সে কলটা রিসিভ করল।
আমি ভাবলাম সমুদ্রের তলদেশ ছবি তুলতে চলে গেছেন বুঝি!
হা হা হা. . . দারুণ ভাবনা। ছবি নেওয়ার জন্য অগ্রিম বুকিং করতে এসেছো?
আজ্ঞে না! সেই সাতসকালে একটা লেখা পাঠিয়েছি, সেটা একটু দয়া করে দেখতে বলার জন্য ফোনটা করলাম।
ওহো, ভেরি সরি, একটা খুব দরকারি কাজের জন্য ব্যস্ত ছিলাম। ঠিক আছে দেখে নিচ্ছি।
আমি জানি আপনি খুব কাজের মানুষ, তাই তো নাড়িয়ে দিতে এলাম।
সেঁজুতি র সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সে লক্ষ্য করল, কৌশানীর সবুজ আলো। মুহূর্তে তাকে মেসেজ পাঠালো- আজ দারুণ একটা মুহূর্ত দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সঙ্গে সঙ্গেই লাভ ইমোজি এল।
মুহূর্তে মঞ্চের সব আলো নিভে গিয়ে মুখের উপরেই স্পট লাইট জ্বলে উঠল। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা কাটিয়ে যখন দুজনে ক্ষান্ত হল, ঠিক তখনই সমাদৃতা র মেসেজ ঢুকল।
খুব ব্যস্ত?
রণিত পাত্তা না দিয়ে গুগলে ঢুকল। কিছুটা দরকারি সময় কাটিয়ে উত্তর দিল- না, বলুন।
আজকাল নেট অফ্ রেখে ব্যস্ত থাকেন নাকি?
এটা একটা খোঁচা, সেটা বুঝতে তার বাকি রইলনা। কৌশানীর মুখটা মনে করে হঠাৎই তার মাথাটা গরম হয়ে গেল।
কোন ইভেন্ট কভার করার সময়ে আমার নেট অফ্ই থাকে। সারাদিন খুব ধকল গেছে, এখন ভীষন ক্লান্ত।
সরি, আপনাকে অযথা ডিস্টার্ব করে ফেললাম।
সমাদৃতার সবুজ আলো নিভে গেল। রণিত বেশ তৃপ্তি নিয়ে শুতে গেল।
মানুষের সুখের দিনে সময় যেন হু হু করে কেটে যায়। রণিতের এখন তাই অবস্থা। দু’দিনে এখন তারা তুমির পর্যায়ে চলে এসেছে। সে বেশিদিন কারোর সঙ্গে আপনি, আজ্ঞে করে কথা বলতে পারে না। কৌশানী মডেল হতে চায়, দারুণ অ্যাম্বিশন। মডেল হওয়ার মতো সব গুণই রণিত তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে। তাই আজ গঙ্গার ধারে ক্যাফেতে মিঃ জয়শোয়ালকে ডেকে নিয়েছিল।
জয়শোয়াল প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষ, তবুও রণিতের ডাকে এসেছে।কৌশানীর অ্যালবাম দেখেছে এবং যাবার আগে আশ্বাস দিয়ে গেছে কৌশানীর সঙ্গে বসার ব্যাপারে। খুশির খবরটা কৌশানীকে দেবার জন্য সে ফোন করল। রিং হয়ে গেল। সে মেসেঞ্জার ওপেন করল। কৌশানী র লাস্ট সিন মিনিট দশেক আগেই। খবরটা লিখতে গিয়েও কি ভেবে বেরিয়ে এল আর ঠিক তখনই তার চোখ সমাদৃতার ইনবক্সে আটকে গেল।
একটা মেসেজ দুদিন ধরে অপঠিত অবস্থায় পড়ে আছে। এই দু’দিনে তার মেসেঞ্জারে ঢোকার প্রয়োজনই পড়েনি। কি মনে হতে সে ইনবক্সে ইন করল।
আমি জানি গত দু’মাস ধরে আপনি আমার উপর যারপরনাই বিরক্ত হয়ে আছেন। আমার এড়িয়ে যাওয়া আপনার চোখ এড়িয়ে যায় নি। কিন্তু কি করব বলুন ভগবান যার হাতে মৃত্যুর পরোয়ানা ধরিয়ে দিয়েছে সে আর কি করে স্বাভাবিক হতে পারে! এতখানি পড়ে রণিতের যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। সে এক নিঃশ্বাসে পড়ে যেতে লাগল। গতকাল আপনার সঙ্গে হয়তো শেষ কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। কারণ আগামীকাল আমার ব্রেইন টিউমার অপারেশন হবে। চান্স 80/20। তবুও বাবা মা হাল ছাড়তে চায় না। জানিনা আর কোনদিন কথা হবে কি না। খুব ভালো থাকবেন। বিদায়।
হঠাৎই রণিতের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে সমাদৃতার নাম্বারে ফোন করল। সুইচ অফ। তার সবকিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যেতে লাগলো। সেই জন্যই সমাদৃতা অনেকদিন নিজের ছবি পোস্ট করত না। অনেক সময়ই মেসেঞ্জারে ঠিকঠাক উত্তর দিত না। সেইজন্যই দু’একবার ভেলোরের কিছু মনোরম দৃশ্য পোস্ট করেছিল। পোস্টের কমেন্টেও কোন উত্তর দিত না। সমাদৃতা বরাবরই ইনট্রোভার্ট হলেও তার এহেন অসংলগ্ন আচরণে তার একটুও সন্দেহ জাগল না কেন! কেন একটু কথা বললনা সেদিন। অথচ তার জীবনের নানা উত্থান পতনে সমাদৃতা প্রথম থেকেই সুন্দর পরামর্শ দিত। কি করে সে এই দিনগুলো ভুলে গিয়ে শুধু তার ত্রুটি খুঁজে বেড়াত! শুধুমাত্র নিজে এগিয়ে যাবার অজুহাতে?
রণিত বাইরের দিকে তাকাল। সূর্য ডোবার পালা। গঙ্গার জলে বিষন্নতার ছায়া। সে যখনই এই ক্যাফেতে আসে, আগে থেকেই এই টেবিলটা বুক করে রাখে কিছু মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে রাখবে বলে। কিন্তু আজ তার কিছুই চোখে পড়ছিল না। হঠাৎই তার সামনের দেওয়ালে চোখ চলে গেল। একটা প্রজাপতি বেরোবার জায়গা না পেয়ে উড়াউড়ি করছে। একবার বসতেই সে খুব সন্তর্পণে তার ডানা ধরে ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে ছেড়ে দিল। প্রজাপতিটা মুক্তি পেয়ে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে কৌশানী কল করে। কিন্তু রণিত রিসিভ করল না!