নীরা দেবী আজকাল প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। একছেলে ও একমেয়ে নিয়ে সংসার। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে, আমেরিকায় থাকে। ছেলে একটি MNC তে উচ্চপদস্থ কর্মচারী।ছেলেও বিয়ে করেছে বছর কয়েক হলো। একটি নাতি আছে। বুম্বা, পাঁচ বছরের। ভীষণ আদরের।
ছেলে মেয়ে যখন খুব ছোট তখন নীরাদেবীর স্বামী অনিমেষ বাবু হঠাৎ করেই চলে গেলেন। নীরাদেবী ছোট ছোট বাচ্চা দুটোকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখেছিলেন সেদিন! পরে অবশ্য নিজেকে সামলে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। ছেলে-মেয়ে দুজনকেই উচ্চশিক্ষিত করেছেন। আজ তারা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই লড়াই করতে গিয়ে তাকে যে কতকিছু সহ্য করতে হয়েছে!
বাড়ি বাড়ি ঘুরে শাড়ি বিক্রি, অনুষ্ঠানে রান্নার কাজ- সব করেছেন! অবশেষে একটি সরকারি স্কুলে আয়ার কাজ পাওয়ার পর ছেলে-মেয়ে দুটো কে কষ্ট করে বড় করে তুলেছেন। এই পাঁচ বছর হলো অবসর নিয়েছেন।
ছেলে নিলয় খুব যত্ন করে মায়ের। বৌমা রূপাও ভীষণ ভালো। শাশুড়ি মায়ের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যের ত্রুটি করে না সে। আসলে রূপার মা ছোটবেলায় মারা গেছেন! মাতৃহারা রূপা মায়ের মমতা শাশুড়ি মায়ের কাছে খুঁজে পেয়েছে। তাই সেও শাশুড়ি মা’কে নিজের মায়ের মত ভালোবাসে।
এদিকে নীতাকে আমেরিকায় বিয়ে দিয়ে নীরাদেবী মেয়ের অভাব বোধ করতেন! অবশ্য নীতা কিছুদিন পর পর নীরাদেবীকে ফোন করে। আমেরিকায় যাওয়ার জন্য পীড়াপীড় করে। কিন্তু নীরাদেবী যেতে চান না।
তিনি বলেন- না রে.. ওইসব জায়গায়, আমি প্রাণখুলে শ্বাস নিতে পারবনা! আমার এখানেই ভালো লাগে। তাছাড়া তুই তো দু’বছর পর পর আসিস, ওতেই আমি খুশি।
সেই মেয়ের অভাব রূপা পূর্ণ করে দিয়েছে।
দেখলে বোঝাই যায় না ওরা শাশুড়ি-বৌমা!
মনে হয় মা-মেয়ে!
গত কয়েক দিন ধরে নীরাদেবী অসুস্থ হওয়ায় রূপা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আবার রাত্রে নীরাদেবীর রুমে এসে ঔষধ খাইয়ে চেয়ারে বসে থাকে। নীরাদেবী ঘুমিয়ে পড়লে ধীরে ধীরে ও নিজের রুমে যায়। আবার ভোর ছ’টায় উঠেই প্রথম শাশুড়ি মায়ের রুমে দৌড়ে আসে! সবকিছু ঠিকঠাক আছে দেখে নিয়ে চা করে নিয়ে আসে নিলয় আর ওর জন্য। শাশুড়ি মায়ের জন্য হরলিকস ।
দশ’টা বাজলেই শাশুড়ি মা’কে রুম থেকে নিয়ে আসে ব্যালকনিতে। মোড়ায় বসিয়ে স্নান করিয়ে তারপর রুমে নিয়ে যায়। সকালের ব্রেকফাস্টে নীরাদেবী হালকা খেতেই পছন্দ করেন – কোনোদিন ওটস্, কোনোদিন মুড়ি, চিড়ে এগুলিই খান।
দুপুরে মাছের ঝোল, ডাল, গরম ভাত একটা ভাজা ব্যস। রূপা নিজে মেখেই খাইয়ে দেয়। তারপর ঔষধ খাইয়ে একটু রেস্ট নিতে বলে। রাত্রে দুটো রুটি, সব্জী ও ঔষধ খাইয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নিজের রুমে।
এইভাবেই গত কয়েক দিনের সেবা শুশ্রূষায় নীরাদেবী এখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন।বুম্বাও ঠাম্মার সঙ্গে মাঝে মাঝে গিয়ে বসে গল্প শোনার জন্য, রূপকথার। রূপা আজকাল বুম্বাকে বারণ করে, “ঠাম্মা কে বেশি জ্বালাতন করো না বাবা, ঠাম্মার শরীর খারাপ, ভালো হয়ে উঠলেই আবার তোমার সঙ্গে অনেক গল্প করবে।” বুম্বাও মায়ের কথা শোনে,বোঝে।
নীরাদেবী সকালবেলা ব্যালকনি বসে আছেন। রূপা সারাদিনের কাজে ব্যস্ত। একলা বসে মনে মনে ভাবেন- ভাগ্য করেই এমন বৌমা পাওয়া যায়!
নীরাদেবী রূপাকে ডাকলেন- বৌমা, একবার এদিকে এসো তো মা…
রূপা একদৌড়ে রান্না ঘর থেকে এলো- কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকব?
আরে না, না, এখন আমি অনেকটা সুস্থ। তোমাকে একটা কথা বলব তাই ডেকেছি!
কি কথা মা! রূপা জিজ্ঞেস করলো…
বৌমা তুমি যেভাবে আমার সেবা করছো, আগের জন্মে আমার মা ছিলে মনেহয়…
তোমাকে পেটে ধরিনি, কিন্তু তুমি পেটের মেয়ের চাইতেও বেশি যত্ন করেছ মা। প্রাণভরা আশীর্বাদ করি। নীরাদেবী বুকে জড়িয়ে ধরলেন বৌমাকে। চোখের কোণায় চিক্ চিক্ করছে জল।।