সময় সবকিছু বদলে দেয়। ইচ্ছে থাকলেও, সাধ জাগলেও, সৌম্য কোনোদিন অন্বেষার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। মাঝে মাঝে ভেবেছিল, হয়তো একদিন লিখবে, একদিন ফোন করবে—কিন্তু সেই সাহসটা আর জোগাড় হয়নি।
অন্বেষা এদিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। নিজের লেখালেখিকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছে নতুন এক জগৎ। তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ছাপা হচ্ছে দেশের বড়ো বড়ো পত্রিকায়। সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে তার নাম যশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি নিজের একটি নাট্য সংস্থাও তৈরি করেছে, যার প্রতিটি মঞ্চনাটক দর্শকের মনে নাড়া দেয়।
অপরদিকে সৌম্য—ভাগ্যের পরিহাসে, একের পর এক ধাক্কায়, নিজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কখনোই স্থায়ী হতে পারেনি। দুর্ঘটনার পর স্মৃতিশক্তির ক্ষতি হয়েছিল, শারীরিক দুর্বলতা নিয়েও তাকে লড়াই করতে হয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে পার্ট টাইম শিক্ষকতা করেছে, কখনো চাকরি মিলেছে, আবার ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত চাকরির বাজার।
কিন্তু সংসার ভেঙে পড়েনি। কারণ সঞ্চারী—বিয়ের আগেই স্কুলের চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। নিজের সংসারকে শক্ত হাতে আগলে রেখেছিল সে। সৌম্যের লড়াই যতই কঠিন হোক, সঞ্চারী প্রতিটি মুহূর্তে তার পাশে থেকেছে।
অবশেষে সৌম্য স্থায়ী কলেজের চাকরি পায়। প্রথমে মফস্বল কলেজে, পরে ছেলের কাছে থাকতে ও পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য মিউচুয়াল ট্রান্সফার নিয়ে আবার নিজের পুরোনো জায়গা— নিজের কলেজে ই ফিরে আসে।
আর এখানেই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।
কলেজের করিডোরে একদিন, হঠাৎই চোখের সামনে দাঁড়িয়ে গেল অন্বেষা।
বইমেলায় শেষ দেখা হওয়ার পর প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেছে।
দু’জনেই থমকে দাঁড়াল, কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর শুকনো হাসি । এভাবেই যে কতদিন চলেছিল, তা বেশ একটা মনে পড়ে না।
প্রথমদিকে সৌম্য কথা খুঁজে পেত না। বুকের ভেতর একটা লজ্জা, অপরাধবোধ, আর অদ্ভুত এক শূন্যতা তাকে আটকে রাখত সারাক্ষণ।
কিন্তু অন্বেষাই একদিন প্রথম হাত বাড়িয়ে দিল—
“এতদিন পর, সৌম্য… এবার তো কেবল নীরবতা মানায় না।”
সেই মুহূর্তেই সৌম্যের বুক হালকা হয়ে গেল।
কতদিন জমে থাকা কথাগুলো যেন উথলে উঠল।
ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে, সব খুলে বলল অন্বেষাকে—দুর্ঘটনা, কোমার দিনগুলো, সঞ্চারীর অকৃত্রিম সেবা, মায়ের ইচ্ছা, সংসারের বাঁধন, বাবাইয়ের হাসি—সব।
অন্বেষা শুনল, গভীর মনোযোগে।
কোনো উত্তর দিল না।
না অভিযোগ, না ক্ষমা।
শুধু চোখের ভেতর এক নিঃশব্দ অভিমান লুকিয়ে রইল। হয়তো কষ্টে, হয়তো দুঃখে, হয়তো অন্য কোনো অজানা কারণে সে চুপ করেই থাকল।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেল।
কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দু’জনের কাঁধে এসে পড়ল। একসঙ্গে রিহার্সাল, অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ততা—এইসব মিলেই আবার তৈরি হলো এক নীরব বন্ধুত্বের সেতু।
অন্বেষা জানত সঞ্চারী আর বাবাইয়ের কথা। জানত সৌম্যর সংসারের প্রতিটি বাঁধন। তবুও সম্পর্কটা অস্বস্তিকর হয়ে ওঠেনি। বরং পরিণত, শান্ত বন্ধুত্বে রূপ নিল।
সৌম্য অবশ্য কোনোদিন সাহস করে অন্বেষাকে বলতে পারেনি—
“তুমি আজও আমার জীবনের অদৃশ্য অধ্যায়।”
কারণ সম্পর্কটা এখন কেবল বন্ধুত্বের।
তবুও সেই বন্ধুত্বের ভেতরে লুকিয়ে থাকে না বলা কিছু কথা, অসম্পূর্ণ কিছু অনুভূতি—যা আকাশের মেঘের মতো জমে থাকে, কিন্তু ঝড়ে নামে না বৃষ্টি হয়ে..
ক্রমশ…