সেদিন সৌম্য বাড়ি ফিরল রাত দশটার পর। ক্লান্ত মুখ, গায়ে পারফিউমের হালকা গন্ধ আর ফোনে কারও সঙ্গে কিছুটা চাপা গলায় কথা বলছিল। সঞ্চারী দেখল—কিন্তু কিছু বলল না।
পরদিন আবার ফোনে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে কথা বলতে দেখল সৌম্যকে, আর ফোনটা কেটে ফেলল সঞ্চারীর উপস্থিতি টের পেয়েই।
সঞ্চারীর মনে প্রশ্ন জাগল—কী এমন কথা যা তার সামনে বলা যায় না? কে ফোন করে সৌম্যকে ? কি এমন কথা বলে যাতে সৌমকেএত হাসাতে পারে?
সন্দেহ ধীরে ধীরে বিষের মতো গ্রাস করতে শুরু করল সঞ্চারীর মন। সে সৌম্য এর ফোন চেক করতে শুরু করল, গোপনে তার ব্যাগে চোখ রাখল, খেয়াল করল সোমের জামায় কোনো অচেনা লিপস্টিকের দাগ আছে কিনা। প্রতিটি ছোট্ট ঘটনাও বড় হয়ে উঠতে লাগল তার মনে।
একদিন সৌম্যের হোয়াটসঅ্যাপে ডিপিতে লেখা পঙক্তি দেখে সঞ্চারীর গলা শুকিয়ে এল:
“তুমি যদি আসো, সবকিছু ছেড়ে দিতে পারি আবার…..
নাম নেই, ঠিকানা নেই। কাকে উদ্দেশ্য করে সৌম্য এই কথা বলেছে?
সঞ্চারী বলল না কিছুই। কিন্তু তাঁর মন যেন কুরে কুরে খেতে লাগল তাকে। রাতে ঘুম না হলে সে ছাদে উঠে বসে থাকে একা, সৌম্য পাশের ঘরে ছেলেকে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত। সম্পর্কের মধ্যে যেন হালকা ফাঁক তৈরি হচ্ছিল, কেউ টের পাচ্ছিল না ঠিকভাবে—কিন্তু অনুভব করছিল।
আর একদিন সৌম্য কলেজে যাওয়ার সময় বলল আজকে আমার আসতে দেরি হবে।রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি যাব। সঞ্চারী মনে মনে ভাবল তুমি আগে যেখানেই যেতে আগের দিন আমাকে বলতে। আমি ঠিক করে দিতাম তুমি কোন প্যান্ট ,কোন শার্ট পড়বে । কি টিফিন নিয়ে যাবে। সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধ আছে কিনা।কিন্তু তুমি এখন আমাকে আগের থেকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করো না।আজকাল তুমি আমাকে কি লুকাচ্ছো কে জানে? কিন্তু সৌম্যকে সৌম্যকে বুঝতে দিল না তার মনের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ উথাল পাতাল খাচ্ছে। বলল না কিছু সে শুধু মুচকি হাসলো।
সঞ্চারী অনুভব করল সৌম্য তার হাতের নাগালের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে সব সময় ফোনে ব্যস্ত থাকে। অধিকাংশ সময় সে বাইরে কাটায়। কিছু বললেই বলে যে আমি কাজে ব্যস্ত আছি ,লেখালেখি, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যস্ত আছি ।গবেষণায় কাজে বাইরে যাচ্ছি।
এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর সঞ্চার একদিন সে ঠিক করল, মুখোমুখি কথা বলবে। রাতে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সে সৌম্যকে জিজ্ঞেস করল:
— “তুমি কি কিছু লুকোচ্ছো আমার থেকে?”
সৌম্য চমকে উঠল। তার মুখে তখন হতবাক অভিব্যক্তি।
— “কী বলছ তুমি সঞ্চারী? কী লুকাব?”
সঞ্চারী বলল, তুমি সব সময় আমাকে এড়িয়ে যাও কিছু বললেই বল আমি ব্যস্ত আছি। আমার খুব চাপ। ফোনে তুমি সব সময় ব্যস্ত। কার সঙ্গে বা এত মজা করে কথা বলো? কেন আমার সামনে ফোন কেটে দাও?”
সৌম্য তখন একটু চুপ করে থাকল, তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল :
— “সঞ্চারী, আমি সম্প্রতি একটি নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। কলেজের এক সহকর্মী, নাম অন্বেষা সে নাটকে অভিনয় করে নাট্য চর্চা করে, সে অনুরোধ করেছিল ওদের একটা যে নাট্য সংস্থা আছে তাদের একটি প্রজেক্টে সাহায্য করতে। আমি একটু রিহার্সালের জন্য সময় দিচ্ছি, ওর সঙ্গেই ফোনে কথা হয়। আমি জানি, তোমাকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু ভাবছিলাম তুমি হয়তো সবই বুঝতে পারো । এখন দেখি, না বলা ভুল হয়েছে।”
সঞ্চারী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার চোখে জল এসে গেল।
সঞ্চারী বলল— “তুমি যদি আমাকে বলতেই, আমি বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তুমি লুকিয়ে করলে বলেই বিশ্বাস হারিয়ে গেল। সম্পর্ক টিকে থাকে বিশ্বাসে, সৌম্য। তুমি সেটা বুঝলে না”
সৌম্য ক্ষণিক চুপ করে রইল। সে বুঝতে পারছিল, সম্পর্কের ভিত এ কোথায় ফাঁটল ধরেছে।
সঞ্চারে আবার বলতে শুরু করলো—”তুমি তো লেখালেখি কর , সংস্কৃতি চর্চা করো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারো আমি কি কখনো তোমাকে কিছু বলেছি না বাধা দিয়েছি।তুমি তোমার মতো করে বাঁচবে, আমিও সব সময় তোমার পাশে পাশেই আছি। আমি শুধু চাই, তুমি আমার সঙ্গে সব ভাগ করে নাও।”
গভীর রাত। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে। ঘরের কোণায় রাখা কাপের কফিতে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু কারও আর তা খাওয়ার ইচ্ছে নেই। দুইজন মানুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা নিস্তব্ধতার কঠিন প্রাচীর….
ক্রমশ….

