নীলাদ্রি প্রথমবার তার বিবাহ বার্ষিকীর দিন বড় উদাস। তার প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে বিবাহিত জীবন আর টিকবে না? অনেক বার সেলাই করা এই সংসারটা টিকিয়ে রাখা মুশকিল। তবু সে চেষ্টা করে চলেছে তার সংসারটাকে বাঁচাবার জন্য। শুধু ভালোবাসা নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে এই সংসারটাকে বেঁধে রাখার পেছনে। আজ উৎসাহ উদ্দীপনা কম থাকলেও তিনজনের মত সব আয়োজন করলো সে নিজের হাতে। আজকে সে সবার রান্না করল। এমনিতেই রান্না করতে তার ভালো লাগে, তার উপর আজকে একটা বিশেষ দিন। যদিও বিকেলে বাইরে খেতে যাওযার কথা ছিল। কিন্তু ছেলে জিৎ একেবারে স্কুল থেকে টিউশন পড়ে ফিরবে। দেরি হবে। তাই আজ আর বাইরে যাবে না বলেছে। কাজের মাসি রান্নার জন্য সব রেডি করে চলে গেছে। প্রীতমা অফিসে গেছে।
প্রীতমার, বিশেষ করে জিৎ, মুখের দিকে তাকিয়েই অন্তঃসারশূন্য এই সংসারটাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে নীলাদ্রি। প্রীতমা, তাঁর স্ত্রী অনেকটা বদলে গেছে। সে আগে অনেকটাই ঘরোয়া প্রকৃতির ছিল। সেই পুরনো বীণার সুর ছিঁড়ে গেছে, আজ যেন সেখানে গিটারের সুর। ওয়েস্টার্ন কালচারে সে নিজেকে সুসজ্জিত করে নিয়েছে।
একসময় নীলাদ্রিও তাই চাইত। গ্রামের মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল। শহরের উপযুক্ত করার জন্য, তাকে নতুন রূপ দেওয়ার জন্য সব রকম পদক্ষেপই সে নিয়েছে। ধীরে ধীরে প্রীতমা বাইরে বেরিয়েছে, স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য একটা চাকরিও জোগাড় করেছে। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। অফিসের কলিগের সাথে নতুন প্রেম আলাপটা নীলাদ্রি কিভাবে মেনে নেবে? এটা কি তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ? কোন স্বামীর পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সেই কারণেই দুজনের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে।
প্রীতমা প্রথম প্রথম বলতো অবশ্য- বিনাশের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তুমি শুধু শুধু সন্দেহ করছো, ও শুধু আমার ভালো বন্ধু। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে ছেলে বন্ধু কি থাকতে নেই? '
নীলাদ্রি কিছুতেই তার কথা মেনে নিতে চাইতো না। বলত- ওসব কেমন বন্ধুত্ব আমার সব জানা আছে। ওসব ছেলেরা তোমাদের মতো দুর্বল মেয়েদের ফাঁসাবার জন্য ফাঁদ পেতে থাকে আর তুমি সেই ফাঁদে পা দিয়েছো।
প্রীতমা পাল্টা জবাব দেয় – পা দিয়েছি, ভালো করেছি।
এই ধরনের অশান্তি অনেক বার হয়েছে। অনেক তর্ক হয়েছে। প্রীতমা বলেছে- দরকার হলে তোমাকে ছাড়ব, ওকে ছাড়তে পারবনা। তোমার ইচ্ছে থাকলে ঘর কর। ইচ্ছে না থাকলে করোনা। আমি তোমায় জোর করব না।
নীলাদ্রি বলে- তুমি ভুলে যাচ্ছ আজকে যেখানে তুমি দাঁড়িয়ে আছো আমার জন্য।
- হ্যাঁ জানি। বারবার খোঁটা দেওয়ার দরকার নেই। আমি গ্রামের মেয়েছিলাম তুমি শহুরে বানিয়েছো। তাঁর জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
- সমাজের ভয় না থাকলে তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিতাম।
- সেই ভয় থেকে মুক্ত হও, তাহলে আমাকেও মুক্তি দিতে পারবে। এসব শুনে নীলাদ্রি গা রি রি করতে থাকে থাকে। রাগের মুহূর্তে ঘরে দু একটা জিনিস ছুড়ে ভেঙেও ফেলে। এভাবেই চলতে থাকে দিন। নীলাদ্রি নিজেকে বুঝিয়ে আজ এই বিশেষ দিনের জন্য তবু ছুটি নিয়েছে। প্রীতমা ছুটি পাবে না বলেছেন। নীলাদ্রির ধারণা ইচ্ছে করেই প্রীতমা ছুটি নেয়নি। একবার তর্ক হয়ে গেছে গতকাল রাতে। নীলাদ্রি বলেছে- আমি জানি ওর সাথে দেখা হবেনা বলে তুমি ইচ্ছে করে ছুটি নাওনি। প্রীতমা উল্টো তর্ক করে বলেছে- ঠিকই বলেছ। আমি ওকে ছাড়া একদিনও থাকতে পারিনা। নীলাদ্রি বলে- থাকছো কেন তবে?আমাকে ছেড়ে দিলেই তো পারো। -ছেড়ে তো কবেই দিতাম, শুধু জিৎ এর জন্য। ছেলেটা না থাকলে কবেই ছেড়ে দিতাম। তবে এবার বোধ হয় ভাবার সময় এসে গেছে।
- তার মানে তুমি ডিভোর্স নিতে চাও?
- হ্যাঁ তাই চাই। তুমি একটু দেরি করে বুঝলে। তুমি যেটা শুনলে, বুঝলে ঠিক সেটাই। তোমাকে নতুন করে বোঝাবার কিছু নেই, তোমাকে বোঝাতেও চাই না। মুখ ভার করেই আজ প্রীতমা ঘর থেকে বেরিয়েছে। তবু ছেলেটার মনটা খারাপ হয়ে যাবে ভেবেই এই দিনটির আয়োজন। নীলাত্রি সোফায় বসে এইসব ভাবতে থাকে। প্রীতমা যখন অফিস থেকে ফিরল সঙ্গে বিনাশ। দরজা খুলে প্রীতমাকে দেখে হাসতে গিয়েও বিনাশকে সঙ্গে দেখে নীলাদ্রির মুখটা ভার হয়ে গেল। বিনাশকে দেখে নীলাদ্রির পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে গেল। প্রীতমা বিনাশকে বলল তুমি বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। বিনাশ বলল- ঠিক আছে, তুমি যাও আমি নীলাদ্রির সাথে গল্প করি। প্রীতমা ঘরে ঢুকে যেতেই বিনাশ নীলাদ্রির দিকে এগিয়ে আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে বলল- অনেক শুভেচ্ছা ভাই। নীলাদ্রি হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল- শুভেচ্ছা আমার জন্য নয়, শুভেচ্ছাতো তোমাদেরকে দেওয়া উচিত। বিনাশ বলল- মানে? তুমি সব জানো? প্রীতমা সব বলে দিয়েছে আগে থেকে। নীলাদ্রি বলল- তোমাদের নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল। আমি তো প্রীতমাকে সুখী করতে পারলাম না, আমি ওর মনের মতো হয়ে উঠতে পারলাম না। তোমার সাথে ও খুব ভালো থাকবে আশা করি। ওকে খুব ভালো রেখো -আমি ! আমি প্রীতমাকে ভালোবাসবো !মানে?
- তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো। তোমরা তো বিয়ে করছো? প্রীতমা তোমার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে রেখেছে। আর তুমি আমাকে মানে জিজ্ঞাসা করছো? বিনাশ একটু বিরক্ত হয়ে বলল -কি সব আজেবাজে কথা বলছো ভাই? নীলাদ্রি ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল- ভাই? ওই কথাটি বলোনা? মুখে মিষ্টি করে ভাই বলছো? আর পেছনে ছুরি মারছো। বিনাশ বলে – তুমি ভুল করছো কোথাও আর এই ভুলের জন্য তোমাকে মাশুল গুনতে হবে অনেক। -ভুল আর আমি, কিভাবে? -তুমি কিন্তু প্রীতমাকে ভুল বুঝছো। তুমি যেমনটা ভাবছো ওর সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা শুধু বন্ধু। আমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসি। আমরা ছোটবেলা থেকে একে অপরের বন্ধু। ইন্দিরা পড়াশোনার জন্য বাইরে ছিল। ফিরে এসেছে। সামনের মাসে আমাদের বিয়ে। আজ তাই নিমন্ত্রণ করতে এলাম। যদিও দুদিন পরেই আসতাম। প্রীতমা বলল- আজই চলো, আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। একসাথে খাওয়া দাওয়া করবো। ভালো লাগবে। কিন্তু এখানে তো দেখছি অন্য ঘটনা। তুমি আমার সাথে প্রীতমাকে জড়িয়ে সন্দেহ করতে সে কথা তো সে আমাকে কখনোই বলে নি। নীলাদ্রি ভীষণ লজ্জিত হলো। ভাবল অযথা সন্দেহ করে একটা সুস্থ সম্পর্ককে কতটা নড়বড়ে করে ফেলেছি। হয়তো একটা সময় গিয়ে সম্পর্কটা ভেঙে যেতো। নীলাদ্রি বিনাশের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলো। বিনাশ বলল- সম্পর্কে বিশ্বাস বড় কথা। আমি ও আমার ভালবাসা ছ’বছর আলাদা। কিন্তু ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র মরচে পড়েনি। আমিও তো ভাবতে পারতাম সে বিদেশে গেছে, সেখানে কোন বিদেশীকে দেখে পছন্দ হলে আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু না, আমি ভেবেছি যে আমি ওকে এতটাই ভালবাসি যে ও আমাকে ছাড়া আর কারো কথা ভাবতেই পারবে না। নীলাদ্রি আরো লজ্জিত হলো তার ব্যবহারে। সে বুঝল- সাজ পোশাকে নয় মানসিকতা ও চিন্তাভাবনায় আধুনিক হওয়া উচিত। বিনাশ চলে যাওয়ার পর নীলাদ্রি প্রীতমাকে কাছে টেনে বলল- আমাকে ক্ষমা করো। অনেক অভিমান জমিয়ে রেখেছো তাই না। জানি আমি যা করেছি ক্ষমা হয় না। তবু যদি পারো ক্ষমা করে দিও। প্রীতমা বলল- একটু বুঝলেন আমাকে। আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসি না আর তোমাকে ছাড়া কাউকে ভাবতেও পারিনা। যখন তোমাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না কথাটা তখন ঠিক করে নিয়েছিলাম তোমার কাছ থেকে দূরে থাকব। রোজ রোজ অশান্তি আর আর অপমান সহ্য করবো না। এ অপমান আমার ভালোবাসার। এভাবে একটা অসুস্থ সম্পর্ককে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না। সম্পর্ক মানে তো বিশ্বাস। এই অবিশ্বাসে আমার মন ঘুরিয়েও যেতে পারত, জেদ আসতে পারত। তখন অন্য পথ বেছে নিতে পারতাম – এ কথাটি কখনো কি ভেবে দেখেছো? কখনো আর এমন করো না। এরপরে আর সহ্য করতে পারব না।নীলাদ্রি হাঁটু গেড়ে বলে বসে পড়ল। বলল- কি বলবো জানি না, যদি পারো আর একবার সুযোগ দাও।
প্রীতমাও বসে নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরলো।