চন্ডীপুর গ্রামটার একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। অন্যান্য গ্রামের মতো নয় । এই গ্রামের শিক্ষিতের হার অন্যান্য গ্রামের তুলনায় বেশি। এখানকার ছেলে ছোকরারা সারাদিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে না । তাদের দু’চোখে স্বপ্ন আছে। তারা স্বপ্ন দেখতে জানে। আর স্বপ্নটাকে কিভাবে সত্যি করতে হয় তাও জানে। হয় তো সব ক্ষেত্রে তারা সফল হয় না। তবুও তারা লড়াই করে। এক কথায় বলতে গেলে তারা প্রচন্ড পরিশ্রমী। তাদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে- প্রথম জীবনটা যদি পরিশ্রম করো তাহলে পরের জীবনটা আরামে কাটাবে। আর প্রথম দিকে যদি ফাঁকি মেরে, আলস্য করে কাটাও, তাহলে পরবর্তী জীবনটা কাটাতে হবে চোখের জল ফেলে এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে।
এই গ্রামের বেশ কয়েকটি ছেলে পড়াশোনা করে এখন বেকার। অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছে কিন্তু কিছু হয় নি। চাকরি হওয়া কি এতই সহজ! হয় বাপের টাকার জোর না হলে কোনো আমলা-মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন হতে হবে! গ্রামের ছেলেগুলোর কিছুই নেই। আছে শুধু খেটে উপার্জন করা কিছু ডিগ্রি এবং বাপের দেওয়া সততার শিক্ষা।
এই ছেলেগুলো বিকেল হলেই চলে যায় একটা গাছের তলায় আড্ডা মারতে। গ্রামের শেষ প্রান্তে রাস্তার ধারে বড় বড় গাছ আছে। সেখানে গাছের তলায় তারা ক্যারাম খেলে। আর চলে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, খেলাধুলা থেকে শুরু করে সব রকমের আলোচনা। পাশেই একটি চায়ের দোকান আছে। সেখানে চা ছাড়াও আলুর চপ, মোচার চপ সহ অনেক রকম চপ তৈরী হয় । বিক্রি বাটাও ভাল হয়। পথ চলতি মানুষগুলো চায়ের সঙ্গে চপ মুড়ি তো একটু খাবেই। আর মেদিনীপুরের মানুষ মুড়ি খাবেন না তা কি হয়!
বাস রাস্তার পাশ দিয়েই গেছে একটা সরু রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে সাধারণত সাইকেল, মোটরসাইকেল বা পায়ে হেঁটে মানুষ যাতায়াত করে। এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন একটি মেয়ে হেঁটে যায় । মেয়েটি কলেজ করার পর কয়েকটি টিউশান করে বাড়ি ফেরে। এটা তারা রোজ দেখে। তারা বলতে গ্রামের ঐ ছেলে ছোকরাগুলো। আজ মেয়েটিকে তারা দেখতে পায় নি। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে – হ্যাঁরে, মেয়েটাকে আজ তো যেতে দেখলাম না ! কি ব্যাপার বলতো!
অর্জুন সেটা শুনেই বলল – হ্যাঁ ঠিক বলেছিস ! আজ তো দেখতে পেলাম না । কোনো বিপদ হল না তো ! চল তো একটু দেখি। হাঁটতে হাঁটতে তারা বড় রাস্তা পেরিয়ে দূরে দেখে একটা রাস্তার উপর একটা মেয়ে পড়ে আছে। ওরা একে অপরের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তখনও তারা বুঝতে পারে নি এই মেয়েটি সেই মেয়েটি কিনা! কাছে গিয়ে দেখে সেই মেয়েটি যাকে তারা রোজ আসতে দেখে। কি করবে তারা এখন! এতো পুলিশ কেস !
অর্জুন বলে যা হয় হবে , চল আগে মেয়েটিকে আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাই। যদি বেঁচে যায়!
নিবারণ বলে, এতো মনে হচ্ছে আলাদা কেস ! শেষে পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হবে !
কেন যে পড়াশোনা করেছিস নিবারণ ? এই অবস্থায় একটা মেয়েকে ফেলে চলে যেতে পারবি ? – ঝাঁঝিয়ে ওঠে অর্জুন। যদি শয়তানগুলো কাছাকাছি থাকে তাহলে মেয়েটাকে শেষ করে দেবে। কেন বুঝতে পারছিস না । তুই চারদিক টা ভালো করে দেখ কাউকে দেখতে পাস কিনা ! বলেই অর্জুনরা নিজেদের পরনের জামাগুলো খুলে ভালো করে মেয়েটাকে ঢাকা দিয়ে রাস্তায় একটা টোটো ডেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করে। সেখানে থেকে হসপিটালে নিয়ে যায়। ভর্তি করবে না পুলিশ কেস। যা আশঙ্কা করেছিল তাই।
ছেলেগুলো কিন্তু ছেড়ে দেবার পাত্র নয় ।
অর্জুন নামে ছেলেটি বলে – আপনারা আগে মেয়েটিকে ভর্তি করুন। আমরা আছি। পালাচ্ছি না। থানায় যেতে হলে যেতে রাজি আছি। আগে মেয়েটিকে বাঁচান।
অর্জুনদের থানায় যেতে হল । যেতেই জেরার পর জেরা।
কোথায় পেলি মেয়েটিকে ?
রাস্তার ধারে একটা ভাঙ্গা প্রাচীরের কাছে পড়েছিল ।
—-তোরা হঠাৎ করে মেয়েটির কাছে পৌঁছালি কি করে ?
—- মেয়েটিকে রোজ ঐ রাস্তা দিয়ে যেতে দেখতাম । আজ দেখতে পাই নি । তাই …
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই থানার এক অফিসার বলে উঠলেন – তাই তোদের স্নেহ , মায়া , মমতা উথলে উঠল মেয়েটির জন্য! সত্যি করে বল। নাহলে বড়বাবু যদি আসেন তাহলে দেখবি …. ঐ তো বড় বাবু এসে গেছেন । আসুন স্যার । এই ছেলেগুলোকে আমরা ধরে এনেছি ।
— ঠিক আছে । ওদের আমার কাছে নিয়ে আসুন । আমি আমার চেম্বারে যাচ্ছি । বলেই বড় বাবু নিজের চেম্বারে চলে গেলেন।
অর্জুনরা বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকতেই বড়বাবু বললেন -তোমরা বসো । তোমরাই তো মেয়েটিকে তুলে হাসপাতালে দিয়েছো ?
—-স্যার বিশ্বাস করুন আমরা মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছি । আমাদের যদি অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতো তাহলে কি আমরা মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতাম! আপনিই বলুন!
--- আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করলাম। তোমরা কি করো ? মানে তোমরা কি কাজ করো ?
সবাই মাথা নিচু করে উত্তর দিল। কোনো কাজ নেই স্যার ! ইন্টারভিউ দিচ্ছি হচ্ছে না । অর্জুন বলে - স্যার আমি বি টেক করেছি । আর ঐ নিবারণ ইংরেজিতে এম এ করেছে । এখন টিউশান করে । আর এই দু'জনের একজন অংকে অনার্স আর একজন ফিজিক্সে অনার্স ।
বড়বাবু মন দিয়ে কথা গুলো শুনে বললেন - তোমরা যখন মেয়েটির খোঁজে যাও তখন কাউকে আশেপাশে দেখতে পেয়েছিলে ?
--- না স্যার পাই নি । তবে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি ।
বড়বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন -তুমি কি ভাবে আমাকে সাহায্য করবে ?"
অর্জুন পকেট থেকে একটা শার্টের ছেঁড়া টুকরো বার করে বড়বাবুর হাতে দিয়ে বলল -এটা ঐ মেয়েটির হাতে ছিল। আমি যত্ন করে রেখেছি। এটাতে কোনো সাহায্য হবে তো স্যার !
বড়বাবু ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন - হবে তো নিশ্চয়ই । খুব ভালো কাজ করেছো অর্জুন ।
----স্যার মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে । এই মাত্র খবর পেলাম। বলেই এক কর্মরত কনস্টেবল চলে গেলেন ।
বড়বাবু চেয়ারে বসেই উত্তর দিলেন- ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। গড়ি বের করতে বলো।
অর্জুন তোমরাও চলো আমার সঙ্গে ।
বড়বাবু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন – মেয়েটির কোনো ক্ষতি হয় নি । এখন সুস্থ আছে ।
বড়বাবু মেয়েটির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন – মা, তুমি ছেলেগুলোকে চিনতে পারবে যদি এখন তাদের এখানে আনা হয়।
—- মেয়েটি মাথা নেড়ে “হ্যাঁ”বলে ।
অফিসার অর্জুনদের চারজনকে নিয়ে এলেন মেয়েটির কাছে। মেয়েটি ভালো করে দেখে ঘাড় নেড়ে বলল -এরা কেউ নয়।
—-তুমি ভালো করে দেখে বল ,ভয় পেও না মা।ব ড়বাবু সাহস দিয়ে মেয়েটিকে বলতে উৎসাহ দিলেন।
——আমি দেখেই বলছি । এই মানুষগুলোর জন্য তো আমি বেঁচে গেছি স্যার।
—–অফিসার কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন- এদের জন্য কেন ?”
—- এদের কথা আর পায়ের শব্দ যখন পায় তখন ঐ শয়তান গুলো আমাকে ফেলে পালিয়ে যায় । এই মানুষ গুলো যদি আর একটু দেরি করে যেত সেখানে তাহলে হয় তো অনেক কিছু ঘটে যেত। এরা তো আমার কাছে ঈশ্বরের মত। দয়া করে ওদের ছেড়ে দিন স্যার।
—-হ্যাঁ, সে তো দেব। তোমাকে আরও কিছু জিজ্ঞেস করার আছে ।”
—-হ্যাঁ বলুন, সব উত্তর দেবো আমি।
—-তুমি লোকগুলোর স্কেচ আঁকার জন্য সাহায্য করবে তো ! তাহলে তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে লোকগুলো।
হ্যাঁ স্যার আমি সব সাহায্য করব, যাতে এই রকম ঘটনা না ঘটে ।
অর্জুন আর বন্ধুরা সবাই বাড়ি ফিরে যায়। মেয়েটির বাড়ির লোকজন এসে অর্জুন আর তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানায় ।
বড়বাবু একদিন অর্জুন আর তার বন্ধুদের ডেকে পাঠালেন। স্বাভাবিক ভাবেই তারা একটু ভয়ে ভয়েই থানায় এলো। এসেই তারা বড়বাবু কে জানিয়ে দেয় -আমরা আর কোনো দিন ওখানে আড্ডা দেবো
না।
—- এই কথা শোনার জন্য আমি তোমাদের ডাকিনি অর্জুন। আমি অন্য কারণে ডেকেছি।
— কি কারণে স্যার ! আর কি কারণ থাকতে পারে। মেয়েটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে । এর থেকে বড় খবর তো আর হতে পারে না।
—– বড়বাবু একটা কার্ড অর্জুনের হতে দিয়ে বললেন- তোমরা গিয়ে দেখা করবে। আমি বলে রেখেছি। তোমাদের একটা কাজ হয়ে যেতে পারে। তবে বেতন বিশাল কিছু হবে না। আর ইন্টারভিউ দিয়ে ঢুকতে হবে। সেখানে আমার কিছু করার নেই। আমি শুধু তোমাদের রাস্তাটা দেখিয়ে দিলাম।ঠিকানাটা তোমাদের নিজেদের খুঁজে নিতে হবে ।
অর্জুন আর তার বন্ধুরা বড়বাবুর কথা শুনে বিস্মিত হয়। তাদের মুখে কোনো ভাষা নেই । তাকিয়ে আছে বড়বাবুর দিকে।
—কি দেখছো হাঁ করে ? তোমাদের মত ছেলেদের খুব দরকার সমাজে। আর শোনো আড্ডাটা একদম বন্ধ করবে না। বাঙালির আড্ডা এখন আর সেই রকম শোনায় যায়না। আড্ডা দিয়েছিলে বলেই একটি মেয়ে চরম সর্বনাশের হাত থেকে বেঁচে গেছে। কফি হাউসের আড্ডা, গাছ তলার আড্ডা, চায়ের দোকানে আড্ডা খুব প্রয়োজন অর্জুন । জানো তো আমরাও আড্ডা দিতাম। আড্ডায় জ্ঞান বাড়ে। যদি সেই রকম আড্ডা হয় ।
—–তাহলে আমরা এখন আসি স্যার। আড্ডায় মাঝে মাঝে আপনাকেও ডাকব । আসবেন তো !”
—-বড়বাবু অর্জুনের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন- নিশ্চয়ই। আমিও তো ক্যারাম খেলতে ভীষন ভালোবাসি। শোনো, কাজটা হবার পর আমাকে জানাতে ভুলোনা।
অর্জুন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে “আড্ডা” স্যার।
— কি বললে অর্জুন ?
—- অর্জুন জিভ বার করে বলে – আচ্ছা স্যার। আসলে মুখ ফসকে “আচ্ছা” বলতে গিয়ে “আড্ডা” বেরিয়ে গেছে স্যার ।
— বড়বাবু মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললেন ,”আড্ডাবাজ” ছেলে। বলেই চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসতে লাগলেন। এই রকম রেজাল্ট করা ছেলেগুলো এখনও বেকার ! হা ঈশ্বর! কি আমাদের পোড়া দেশ! কেউ হীরে চিনলো না! কয়লায় ভরে গেছে দেশটা। আর হীরেগুলো রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে । এরপর মনে হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থাটাই শেষ হয়ে যাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়লেন নিত্য কাজে ।
পরে অপরাধীরা ধরা পড়ে এবং তাদের শাস্তি হয়।
ওদিকে অর্জুন আর তার বন্ধুরা বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করছে। কিন্তু আড্ডা বন্ধ নেই । তাদের জুনিয়ররা এখন গাছের তলায় আড্ডা মারে। বাঙালির আড্ডা কি আর শেষ হয় ! চলতেই থাকে ! চলতেই থাকে….।।