শ্রী কৃষ্ণদ্বৈপায়ন রচিত মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের ২৫ থেকে ৪২ তম অধ্যায় শ্রীমদ্ভগবদগীতা নামে পরিচিত। গীতা ভীষ্ম পর্বের অন্তর্গত হলেও বর্তমানে এটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রূপে স্বীকৃত। ‘গীতা’ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ নি:সৃতবানী। গীতার আর এক নাম ‘যোগশাস্ত্র’ ।শ্রীমদভগবদগীতা মুলত ভীষ্মপর্বে মাত্র ৭০ টি শ্লোকে লিপিবদ্ধ ছিল । ৭০ শ্লোকে লিপিবদ্ধ বলেই একে শপ্তপপ্তি বলা হয়। গীতা যজুর্বেদের কিছু মন্ত্রে ব্যখ্যা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রায় ২৫০০ বছর পরে ৭০০ শ্লোকে গীতা সংকলন হয়। পন্ডিতগণমনে করেন যে অষ্টমশতাব্দীতে শ্রীশঙ্করাচার্য প্রথম এইঅধ্যায়গুলিকে মহাভারত থেকে আলাদা করেন এবং গীতা হিসাবে এর একটি ভাষ্য লেখেন। গীতা-র বিষয়বস্তু শ্রীকৃষ্ণ ও পাণ্ডব রাজকুমার অর্জুনের কথোপকথন।গীতা সনাতন ধর্মতত্ত্বের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ, এবং সনাতনদের জীবনচর্যার একটি ব্যবহারিক পথনির্দেশিকা। শ্রীমদ্ভাগবত গীতা এর অর্থঃ শ্রীমদ্ অর্থ পবিত্র গ্রন্থ;(ভগবদ্ অর্থ ঈশ্বর / গীতা অর্থ গান) । ভগবদ্গীতার অর্থ হল ঈশ্বরের গান এবং শ্রীমদ্ হল এর বিশেষণ। ভগবান শ্রীপরাশসুত কৃষ্ণদ্বৈয়পায়ন বেদব্যাস বিরচিত অষ্টাদশপর্ব সমন্বিত শান্তরস পরিপ্লুত মাহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৫-৪২ পর্যন্ত অষ্টাদশ অধ্যায় সংকলিত অংশ শ্রীমদ্ভগবৎগীতা নামে পরিচিত।এখন প্রশ্ন হতে পারে ভগবদ্গীতা শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, তবে একে গান বলা হয় কেন? কারণ, গীতার মিত্রাক্ষর ছন্দ যখন সঠিক ভাবে উচ্চারণ করা হয় তখন তা খুবই সুন্দর সুরেলা সঙ্গীত এর সৃষ্টি করে। গীতার এই ছন্দকে অনুষ্টুপ্ বলা হয় এবং এর প্রতিটি শ্লোক ৩২ অক্ষর সমণ্বিত।
ধ্যানযোগ :শ্লোক সংখ্যা ১৭
যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্ম্মসু ।
যুক্তস্বপ্নার্দুবোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা ।
অর্থ :
যার খাওয়া ও চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত, যাঁর কর্মে পরিমিত প্রচেষ্টা এবং যার ঘুম ও জাগরণ নিয়ন্ত্রিত, যোগব্যায়াম তার দুঃখের বিনাশকারী হয়ে ওঠে।
ভাবার্থ :
এই শ্লোকে ভগবান যোগব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস, চিত্তবিনোদন এবং অনুরূপ ছাত্রদের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। যোগের ছাত্রের সর্বদা সুখী, মাধ্যম বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা উচিত। ভগবান বুদ্ধ প্রথম দিকে খাদ্য, পানীয় ইত্যাদি বিষয়ে চরম পর্যায়ে গিয়েছিলেন। তার শরীরে খুব অত্যাচার করেছে। তাই তিনি যোগব্যায়ামে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হননি। আত্ম-উপলব্ধির জন্য খুব বেশি তপস্যার প্রয়োজন নেই। সপ্তদশ অধ্যায়ের ৫ এবং ৬ শ্লোকে প্রভু এটিকে নিন্দা করেছেন। কঠোরতার অর্থ আত্ম-নির্যাতন হওয়া উচিত নয়। কৃষ্ণের বুদ্ধি যোগ তপস্যার জন্য একটি বুদ্ধিমান পদ্ধতি। কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী তপস্যাকে লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে; এটা শুধুমাত্র উপায় কিন্তু শেষ নয়, স্নায়ুতন্ত্র অত্যন্ত সংবেদনশীল। এটি খুব সামান্য পরিবর্তনেও সাড়া দেয় এবং মনের বিক্ষিপ্ততা ঘটায়। অতএব, এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে আপনি একটি অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করুন এবং খাদ্য, ঘুম এবং বিনোদনের ক্ষেত্রে মধ্যম হওয়া উচিত। পরিমাপ করা খাবার নিন। নির্ধারিত সময়ে ঘুমান ও জেগে উঠুন। তবেই আপনি যোগে সাফল্য অর্জন করবেন যা এই জীবনের সমস্ত ধরণের বা বেদনা এবং দুঃখের অবসান ঘটাবে ।
পরিমিত আহার বিষয়ে যোগশাস্ত্রের নির্দেশ হল পেটের অর্ধাংশ অন্ন দ্বারা পূরণ করবে, এক চতুর্থাংশ জল দ্বারা পূরণ করবে এবং বাকি এক চতুর্থাংশ বায়ু চলাচলের জন্য খালি রাখবে। এই হিসাবেই অধিক বা কম ভোজন বাঞ্ছনীয় নয়। নিদ্রা সম্পর্কিত নিয়ম হল রাত্রিকে তিনভাগ করে তার প্রথম ও অন্তিমভাগ জাগরণ এবং মধ্যভাগে নিদ্রা যেতে হবে। যোগশাস্ত্রের অপরাপর নিয়মগুলি হল কর্ম এবং চেষ্টাকেও নিয়মিত করতে হবে। অর্থাৎ চলাফেরা, ব্যায়াম, যোগাসন, ক্রিয়া প্রভৃতিও অত্যধিক মাত্রায় না করে স্বাস্থ্য ও শরীর রক্ষার জন্য যতটুকু হিতকর, কেবল ততটুকুই প্রত্যহ নিয়মিত করতে হবে। দিনে চারক্রোশের অধিক পরিভ্রমণ শাস্ত্র-অনুমোদিত নয়। এভিন্ন প্রণব, জপ, শাস্ত্রাদি পাঠ, আবৃত্তি প্রভৃতিও সময়মত প্রত্যহ করার নির্দেশ আছে। সকল প্রকার দুঃখের কারণ অবিদ্যা। একমাত্র ব্রহ্মবিদ্যার সাহায্যেই এই অবিদ্যাকে সমূলে নাশ করা সম্ভব। যোগ সেই ব্রহ্মবিদ্যাই প্রদান করে। অবিদ্যার নাশ হলে কোন দুঃখই থাকতে পারে না। ব্রহ্মবিদ্যা প্রদানকারী এই যোগ সকল সাংসারিক দুঃখকে নাশ করে, সেজন্য একে দুঃখহা বলা হয়।।