অর্জুন উবাচ
প্রকৃতিং পুরুষং চৈব ক্ষেত্রং ক্ষেত্রজ্ঞমেব চ।
এতদ্ বেদিতুমিচ্ছামি জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চ কেশব ৷৷ ১ ।।
শ্রীভগবানুবাচ
ইদং শরীরং কৌন্তেয় ক্ষেত্রমিত্যভিধীয়তে।
এতদ্ যো বেত্তি তং প্রাহুঃ ক্ষেত্রজ্ঞ ইতি তদ্বিদঃ ।। ২ ।।
অর্জুন বললেন- হে কেশব! আমি প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয় এই সমস্ত তত্ত্ব জানতে ইচ্ছা করি। পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে কৌন্তেয়! এই শরীর ক্ষেত্র নামে অভিহিত এবং যিনি এই শরীরকে জানেন, তাঁকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলা হয়।
ক্ষেত্রজ্ঞং চাপি মাং বিদ্ধি সর্বক্ষেত্রেষু ভারত। ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োর্জ্ঞানং যত্তজ্জ্ঞানং মতং মম ।। ৩ ৷৷
হে ভারত! আমাকেই সমস্ত ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ বলে জানবে এবং ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ সম্বন্ধে যে জ্ঞান, সেই জ্ঞানই আমার অভিমত।
তৎ ক্ষেত্রং যচ্চ যাদৃক্ চ যদ্বিকারি যতশ্চ যৎ।
সচ যো যৎপ্রভাবশ্চ তৎ সমাসেন মে শৃণু ।। ৪।।
সেই ক্ষেত্র কি, তার কি প্রকার, তার বিকার কি, তা কার থেকে উৎপন্ন হয়েছে, সেই ক্ষেত্রজ্ঞের স্বরূপ কি এবং তার প্রভাব কি, সেই সব সংক্ষেপে আমার কাছে শ্রবণ কর।
ঋষিভির্বহুধা গীতং ছন্দোভির্বিবিধৈঃ পৃথক্। ব্রহ্মসূত্রপদৈশ্চৈব হেতুমদ্ভির্বিনিশ্চিতৈঃ ।। ৫ ।।
এই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের জ্ঞান ঋষিগণ কর্তৃক বিবিধ বেদবাক্যের দ্বারা পৃথক পৃথকভাবে বর্ণিত হয়েছে। বেদান্তসূত্রে তা বিশেষভাবে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত সহকারে বর্ণিত হয়েছে।
মহাভূতান্যহঙ্কারো বুদ্ধিরব্যক্তমেব চ।
ইন্দ্রিয়াণি দশৈকং চ পঞ্চ চেন্দ্রিয়গোচরাঃ ।। ৬।।
ইচ্ছা দ্বেষঃ সুখং দুঃখং সংঘাতশ্চেতনা ধৃতিঃ।
এতৎ ক্ষেত্রং সমাসেন সবিকারমুদাহৃতম্ ।। ৭ ।।
পঞ্চ-মহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি, অব্যক্ত, দশ ইন্দ্রিয় ও মন, ইন্দ্রিয়ের পাঁচটি বিষয়, ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ সংঘাত অর্থাৎ পঞ্চ মহাভূতের পরিণামরূপ দেহ, চেতনা ও ধৃতি – এই সমস্ত বিকারযুক্ত ক্ষেত্র সংক্ষেপে বর্ণিত হল।
অমানিত্বমদন্তত্বমহিংসা ক্ষান্তিরার্জবম্।
আচার্যোপাসনং শৌচং স্থৈর্যমাত্মবিনিগ্রহঃ ।। ৮৷৷ ইন্দ্রিয়ার্থেযু বৈরাগ্যমনহষ্কার এব চ। জন্মমৃত্যুজরাব্যাধিদুঃখদোষানুদর্শনম্ ।। ৯।। অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু।
নিত্যং চ সমচিত্তত্বমিষ্টানিষ্টোপপত্তিষু ।। ১০।।
ময়ি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী। বিবিক্তদেশসেবিত্বমরতির্জনসংসদি ।। ১১ ।।
অধ্যাত্মজ্ঞাননিত্যত্বং তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম্।
এতজ্ঞানমিতি প্রোক্তমজ্ঞানং যদতোহন্যথা ।। ১২৷৷
অমানিত্ব, দন্তশূন্যতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতা, সরলতা, সদ্গুরুর সেবা, শৌচ, স্থৈর্য, আত্মসংযম, ইন্দ্রিয়-বিষয়ে বৈরাগ্য, অহঙ্কারশূন্যতা, জন্ম-মৃত্যু-জরা- ব্যাধি-দুঃখ আদির দোষ দর্শন, স্ত্রী-পুত্রাদিতে আসক্তিশূন্যতা, স্ত্রী-পুত্রাদির সুখ-দুঃখে ঔদাসীন্য, সর্বদা সমচিত্তত্ব, আমার প্রতি অনন্যা ও অব্যভিচারিণী ভক্তি, নির্জন স্থান প্রিয়তা, জনাকীর্ণ স্থানে অরুচি, অধ্যাত্ম জ্ঞানে নিত্যত্ববুদ্ধি এবং তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন অনুসন্ধান- এই সমস্ত জ্ঞান বলে কথিত হয় এবং এর বিপরীত যা কিছু তা সবই অজ্ঞান।
জ্ঞেয়ং যত্তৎপ্রবক্ষ্যামি যজ্ঞাত্বামৃতমশ্নুতে।
অনাদি মৎপরং ব্রহ্ম ন সত্তন্নাসদুচ্যতে ।। ১৩ ।।
আমি এখন জ্ঞাতব্য বিষয় সম্বন্ধে বলব, যা জেনে অমৃতত্ব লাভ হয়। সেই জ্ঞেয় বস্তু অনাদি এবং আমার আশ্রিত। তাকে বলা হয় ব্রহ্ম এবং তা কার্য ও কারণের অতীত।
সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি ৷৷ ১৪ ।।
তাঁর হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ সর্বত্রই এবং তিনি সর্বত্রই কর্ণযুক্ত। জগতে সব কিছুকেই পরিব্যাপ্ত করে তিনি বিরাজমান।
সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
অসক্তং সর্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ ।। ১৫।।
সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক, তবুও তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত। যদিও তিনি সকলের পালক, তবুও তিনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত। তিনি প্রকৃতির গুণের অতীত, তবুও তিনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।
বহিরন্তশ্চ ভূতানামচরং চরমেব চ।
সূক্ষ্মত্বাত্তদবিজ্ঞেয়ং দূরস্থং চান্তিকে চ তৎ।। ১৬।।
সেই পরমতত্ত্ব সমস্ত ভূতের অন্তরে ও বাইরে বর্তমান। তাঁর থেকেই সমস্ত চরাচর; অত্যন্ত সূক্ষ্মতা হেতু তিনি অবিজ্ঞেয়। যদিও তিনি বহু দূরে অবস্থিত, কিন্তু তবুও তিনি সকলের অত্যন্ত নিকটে।
অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্।
ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ ।। ১৭ ।।
পরমাত্মাকে যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবুও তাঁকে সংহার-কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।
জ্যোতিষামপি তজ্যোতিস্তমসঃ পরমুচ্যতে।
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্বস্য বিষ্ঠিতম্ ।। ১৮ ৷৷
তিনি সমস্ত জ্যোতিষ্কের পরম জ্যোতি। তাঁকে সমস্ত অন্ধকারের অতীত অব্যক্ত স্বরূপ বলা হয়। তিনিই জ্ঞান, তিনিই জ্ঞেয় এবং তিনিই জ্ঞানগম্য। তিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থিত।
ইতি ক্ষেত্রং তথা জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চোক্তং সমাসতঃ।
মদ্ভক্ত এতদ্বিজ্ঞায় মদ্ভাবায়োপপদ্যতে ।। ১৯ ।।
এভাবেই ক্ষেত্র, জ্ঞান ও জ্ঞেয়- এই তিনটি তত্ত্ব সংক্ষেপে বলা হল। আমার ভক্তই কেবল এই সমস্ত বিদিত হয়ে আমার ভাব লাভ করেন।
প্রকৃতিং পুরুষং চৈব বিদ্ধ্যনাদী উভাবপি।
বিকারাংশ গুণাংশ্চৈব বিদ্ধি প্রকৃতিসম্ভবান্ ।। ২০।
প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ই অনাদি বলে জানবে। তাদের বিকার ও গুণসমূহ প্রকৃতি থেকেই উৎপন্ন বলে জানবে।
কার্যকারণকর্তৃত্বে হেতুঃ প্রকৃতিরুচ্যতে।
পুরুষঃ সুখদুঃখানাং ভোক্তৃত্বে হেতুরুচ্যতে ।। ২১ ||
সমস্ত জড়ীয় কার্য ও কারণের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিকে হেতু বলা হয়, তেমনিই জড়ীয় সুখ ও দুঃখের ভোগ বিষয়ে জীবকে হেতু বলা হয়।
পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুঙক্তে প্রকৃতিজান্ গুণান্। কারণং গুণসঙ্গোহস্য সদসদদ্যোনিজন্মসু ।। ২২ ।।
জড়া প্রকৃতিতে অবস্থিত হয়ে জীব প্রকৃতিজাত গুণসমূহ ভোগ করে। প্রকৃতির গুণের সঙ্গবশতই তার সৎ ও অসৎ যোনিসমূহে জন্ম হয়।
উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষ পরঃ ।। ২৩।।
এই শরীরে আর একজন পরম পুরুষ রয়েছেন, যিনি হচ্ছেন উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর এবং তাঁকে পরমাত্মাও বলা হয়।
য এবং বেত্তি পুরুষং প্রকৃতিং চ গুণৈঃ সহ।
সর্বথা বর্তমানোহপি ন স ভূয়োহভিজায়তে ।। ২৪।।
যিনি এভাবেই পুরুষকে এবং গুণাদি সহ জড়া প্রকৃতিকে অবগত হন, তিনি জড় জগতে বর্তমান হয়েও পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করেন না।
ধ্যানেনাত্মনি পশ্যন্তি কেচিদাত্মানমাত্মনা।
অন্যে সাংখ্যেন যোগেন কর্মযোগেন চাপরে ।। ২৫।।
কেউ কেউ পরমাত্মাকে অন্তরে ধ্যানের দ্বারা দর্শন করেন, কেউ সাংখ্য-যোগের দ্বারা দর্শন করেন এবং অন্যেরা কর্মযোগের দ্বারা দর্শন করেন।
অন্যে ত্বেবমজানন্তঃ শ্রুত্বান্যেভ্য উপাসতে।
তেহপি চাতিতরন্ত্যেব মৃত্যুং শ্রুতিপরায়ণাঃ ।। ২৬৷৷
অন্য কেউ কেউ এভাবেই না জেনে অন্যদের কাছ থেকে শ্রবণ করে উপাসনা করেন। তাঁরাও শ্রবণ-পরায়ণ হয়ে মৃত্যুময় সংসার অতিক্রম করেন।
যাবৎ সংজায়তে কিঞ্চিৎ সত্ত্বং স্থাবরজঙ্গমম্। ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞসংযোগাৎ তদ্বিদ্ধি ভরতর্ষভ ।। ২৭।।
হে ভারতশ্রেষ্ঠ! স্থাবর ও জঙ্গম যা কিছু অস্তিত্ব আছে, তা সবই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজের সংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলে জানবে।
সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্। বিনশ্যৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি ।। ২৮।।
যিনি সর্বভূতে সমানভাবে অবস্থিত বিনাশশীল দেহের মধ্যেও অবিনাশী পরমাত্মাকে দর্শন করেন, তিনিই যথার্থ দর্শন করেন।
সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্ ।। ২৯ ৷৷
যিনি সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত পরমাত্মাকে দর্শন করেন, তিনি কখনও মনের দ্বারা নিজেকে অধঃপতিত করেন না। এভাবেই তিনি পরম গতি লাভ করেন।
প্রকৃত্যৈব চ কর্মাণি ক্রিয়মাণানি সর্বশঃ।
যঃ পশ্যতি তথাত্মানমকর্তারং স পশ্যতি ।। ৩০ ।।
যিনি দর্শন করেন যে, দেহের দ্বারা কৃত সমস্ত কর্মই প্রকৃতির দ্বারা সম্পাদিত হয় এবং আত্মা হচ্ছে অকর্তা, তিনিই যথাযথভাবে দর্শন করেন।
যদা ভূতপৃথগভাবমেকস্থমনুপশ্যতি।
তত এব চ বিস্তারং ব্রহ্ম সম্পদ্যতে তদা ।। ৩১ ৷৷
যখন বিবেকী পুরুষ জীবগণের পৃথক পৃথক অস্তিত্বকে একই প্রকৃতিতে অবস্থিত এবং একই প্রকৃতি থেকেই তাদের বিস্তার দর্শন করেন, তখন তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন।
অনাদিত্বান্নির্গুণত্বাৎ পরমাত্মায়মব্যয়ঃ।
শরীরস্থোহপি কৌন্তেয় ন করোতি ন লিপ্যতে ।। ৩২ ৷৷
ব্রহ্মভাব অবস্থায় জীব তখন দর্শন করেন যে, অব্যয় এই আত্মা অনাদি, নির্গুণ ও জড়া প্রকৃতির অতীত। হে কৌন্তেয়! জড় দেহে অবস্থান করলেও আত্মা কোন কিছু করে না এবং কোন কিছুতেই লিপ্ত হয় না।
যথা সর্বগতং সৌক্ষ্ম্যাদাকাশং নোপলিপ্যতে। সর্বত্রাবস্থিতো দেহে তথাত্মা নোপলিপ্যতে ।। ৩৩ ।।
আকাশ যেমন সর্বগত হয়েও সূক্ষ্মতা হেতু অন্য বস্তুতে লিপ্ত হয় না, তেমনই ব্রহ্ম দর্শন-সম্পন্ন জীবাত্মা দেহে অবস্থিত হয়েও দেহধর্মে লিপ্ত হন না।
যথা প্রকাশয়ত্যেকঃ কৃৎস্নং লোকমিমং রবিঃ।
ক্ষেত্রং ক্ষেত্রী তথা কৃৎস্নং প্রকাশয়তি ভারত ।। ৩৪ ।।
হে ভারত! এক সূর্য যেমন সমগ্র জগৎকে প্রকাশ করে, সেই রকম ক্ষেত্রী আত্মাও সমগ্র ক্ষেত্রকে প্রকাশ করে।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োরেবমন্তরং জ্ঞানচক্ষুষা। ভূতপ্রকৃতিমোক্ষং চ যে বিদুর্যান্তি তে পরম্ ।। ৩৫ ।।
যাঁরা এভাবেই জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের পার্থক্য জানেন এবং জড়া প্রকৃতির বন্ধন থেকে জীবগণের মুক্ত হওয়ার পন্থা জানেন, তাঁরা পরম গতি লাভ করেন।।