অর্জুন উবাচ
সন্ন্যাসস্য মহাবাহো তত্ত্বমিচ্ছামি বেদিতুম্।
ত্যাগস্য চ হৃষীকেশ পৃথক্কেশিনিসূদন ।। ১ ।।
অর্জুন বললেন- হে মহাবাহো! হে হৃষীকেশ! কে কেশিনিসূদন! আমি সন্ন্যাস ও ত্যাগের তত্ত্ব পৃথকভাবে জানতে ইচ্ছা করি।
শ্রীভগবানুবাচ
কাম্যানাং কর্মণাং ন্যাসং সন্ন্যাসং কবয়ো বিদুঃ। সর্বকর্মফলত্যাগং প্রাহুস্ত্যাগং বিচক্ষণাঃ ।। ২ ।।
পরমেশ্বর ভগবান বললেন- পণ্ডিতগণ কাম্য কর্মসমূহের ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে জানেন এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ সমস্ত কর্মফল ত্যাগকে ত্যাগ বলে থাকেন।
ত্যাজ্যং দোষবদিত্যেকে কর্ম প্রাহুর্মনীষিণঃ। যজ্ঞদানতপঃকর্ম ন ত্যাজ্যমিতি চাপরে ।। ৩।।
এক শ্রেণীর মনীষীগণ বলেন যে, কর্ম দোষযুক্ত, সেই হেতু তা পরিত্যজ্য। অপর এক শ্রেণীর পণ্ডিত যজ্ঞ, দান, তপস্যা প্রভৃতি কর্মকে অত্যাজ্য বলে সিদ্ধান্ত করেছেন।
নিশ্চয়ং শৃণু মে তত্র ত্যাগে ভরতসত্তম।
ত্যাগো হি পুরুষব্যাঘ্র ত্রিবিধঃ সংপ্রকীর্তিতঃ ।। 8 ।
হে ভরতসত্তম! ত্যাগ সম্বন্ধে আমার নিশ্চয় সিদ্ধান্ত শ্রবণ কর। হে পুরুষব্যাঘ্র! শাস্ত্রে ত্যাগও তিন প্রকার বলে কীর্তিত হয়েছে।
যজ্ঞদানতপঃকর্ম ন ত্যাজ্যং কার্যমের তৎ।
যজ্ঞো দানং তপশ্চৈব পাবনানি মনীষিণাম্ ।। ৫ ।।
যজ্ঞ, দান ও তপস্যা ত্যাজ্য নয়, তা অবশ্যই করা কর্তব্য। যজ্ঞ, দান ও তপস্যা মনীষীদের পর্যন্ত পবিত্র করে।
এতান্যপি তু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ফলানি চ।
কর্তব্যানীতি মে পার্থ নিশ্চিতং মতমুত্তমম্ ।। ৬।।
হে পার্থ! এই সমস্ত কর্ম আসক্তি ও ফলের আশা পরিত্যাগ করে কর্তব্যবোধে অনুষ্ঠান করা উচিত। ইহাই আমার নিশ্চিত উত্তম অভিমত।
নিয়তস্য তু সন্ন্যাসঃ কর্মণো নোপপদ্যতে।
মোহাত্তস্য পরিত্যাগস্তামসঃ পরিকীর্তিতঃ ।। ৭।।
কিন্তু নিত্যকর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়। মোহবশত তার ত্যাগ হলে, তাকে তামসিক ত্যাগ বলা হয়।
দুঃখমিত্যেব যৎ কর্ম কায়ক্লেশভয়াত্যজেৎ।
স কৃত্বা রাজসং ত্যাগং নৈৰ ত্যাগফলং লভেৎ ।। ৮৷৷
যিনি নিত্যকর্মকে দুঃখজনক বলে মনে করে দৈহিক ক্লেশের ভয়ে ত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই সেই রাজসিক ত্যাগ করে ত্যাগের ফল লাভ করেন না।
কার্যমিত্যেব যৎ কর্ম নিয়তং ক্রিয়তেহর্জুন।
সঙ্গং ত্যক্ত্বা ফলং চৈব স ত্যাগঃ সাত্ত্বিকো মতঃ ।। ৯ ৷৷
হে অর্জুন! আসক্তি ও ফল পরিত্যাগ করে কর্তব্যবোধে যে নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান করা হয়, আমার মতে সেই ত্যাগ সাত্ত্বিক।
ন দ্বেষ্ট্যকুশলং কর্ম কুশলে নানুষজ্জতে।
ত্যাগী সত্ত্বসমাবিষ্টো মেধাবী ছিন্নসংশয়ঃ ।। ১০ ৷৷
সত্ত্বগুণে আবিষ্ট, মেধাবী ও সমস্ত সংশয়-ছিন্ন ত্যাগী অশুভ কর্মে বিদ্বেষ করেন না এবং শুভ কর্মে আসক্ত হন না।
ন হি দেহভৃতা শক্যং ত্যক্তুং কর্মাণ্যশেষতঃ।
যস্তু কর্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে ৷৷ ১১ ৷৷
অবশ্যই দেহধারী জীবের পক্ষে সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়, কিন্তু যিনি সমস্ত কর্মফল পরিত্যাগী, তিনিই বাস্তবিক ত্যাগী বলে অভিহিত হন।
অনিষ্টমিষ্টং মিশ্রং চ ত্রিবিধং কর্মণঃ ফলম্।
ভৰত্যত্যাগিনাং প্রেত্য ন তু সন্ন্যাসিনাং ক্বচিৎ ।। ১২ ।।
যাঁরা কর্মফল ত্যাগ করেননি, তাঁদের পরলোকে অনিষ্ট, ইষ্ট ও মিশ্র- এই তিন প্রকার কর্মফল ভোগ হয়। কিন্তু সন্ন্যাসীদের কখনও ফলভোগ করতে হয় না।
পঞ্চৈতানি মহাবাহো কারণানি নিবোধ মে।
সাংখ্যে কৃতান্তে প্রোক্তানি সিদ্ধয়ে সর্বকর্মণাম্ ।। ১৩।।
হে মহাবাহো! বেদান্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্তে সমস্ত কর্মের সিদ্ধির উদ্দেশ্যে এই পাঁচটি কারণ নির্দিষ্ট হয়েছে, আমার থেকে তা অবগত হও।
অধিষ্ঠানং তথা কর্তা করণং চ পৃথগ্রিধম্।
বিবিধাশ্চ পৃথক্ চেষ্টা দৈবং চৈৰাত্র পঞ্চমম্ ।। ১৪ ।।
অধিষ্ঠান অর্থাৎ দেহ, কর্তা, নানা প্রকার করণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ, বিবিধ প্রচেষ্টা ও দৈব অর্থাৎ পরমাত্মা- এই পাঁচটি হচ্ছে কারণ।
শরীরবাঙ্মনোভির্যৎ কর্ম প্রারভতে নরঃ।
ন্যায্যং বা বিপরীতং বা পঞ্চৈতে তস্য হেতবঃ ।। ১৫ ।।
শরীর, বাক্য ও মনের দ্বারা মানুষ যে কর্ম আরম্ভ করে, তা ন্যায্যই হোক অথবা অন্যায্যই হোক, এই পাঁচটি তার কারণ।
তত্রৈবং সতি কর্তারমাত্মানং কেবলং তু যঃ। পশ্যত্যকৃতবুদ্ধিত্বান্ন স পশ্যতি দুর্মতিঃ ।। ১৬।।
অতএব, কর্মের পাঁচটি কারণের কথা বিবেচনা না করে যে নিজেকে কর্তা বলে মনে করে, বুদ্ধির অভাববশত সেই দুর্মতি যথাযথভাবে দর্শন করতে পারে না।
যস্য নাহংকৃতো ভাবো বুদ্ধিৰ্যস্য ন লিপ্যতে।
হত্বাপি স ইমাঁল্লোকান্ন হস্তি ন নিবধ্যতে ।। ১৭৷৷
যাঁর অহঙ্কারের ভাব নেই এবং যাঁর বুদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয় না, তিনি এই সমস্ত প্রাণীকে হত্যা করেও হত্যা করেন না এবং হত্যার কর্মফলে আবদ্ধ হন না।
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং পরিজ্ঞাতা ত্রিবিধা কর্মচোদনা।
করণং কর্ম কর্তেতি ত্রিবিধঃ কর্মসংগ্রহঃ ।। ১৮৷৷
জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা- এই তিনটি কর্মের প্রেরণা; করণ, কর্ম ও কর্তা- এই তিনটি কর্মের আশ্রয়।
জ্ঞানং কর্ম চ কর্তা চ ত্রিধৈব গুণভেদতঃ।
প্রোচ্যতে গুণসংখ্যানে যথাবচ্ছৃণু তান্যপি ।। ১৯ ।।
প্রকৃতির তিনটি গুণ অনুসারে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তা তিন প্রকার বলে কপিত হয়েছে।। সেই সমস্তও যথাযথ রূপে শ্রবণ কর।
সর্বভূতেষু যেনৈকং ভাবমব্যয়মীক্ষতে।
অবিভক্তং বিভক্তেযু তজ্জ্ঞানং বিদ্ধি সাত্ত্বিকম্ ।। ২০ ।।
যে জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত প্রাণীতে এক অবিভক্ত চিন্ময় ভাব দর্শন হয়, অনেক জীব পরস্পর ভিন্ন হলেও চিন্ময় সত্তায় তারা এক, সেই জ্ঞানকে সাত্ত্বিক বলে জানবে।
পৃথক্ত্বেন তু যজজ্ঞানং নানাভাবান্ পৃথগ্-বিধান।
বেত্তি সর্বেষু ভূতেষু তজ্জ্ঞানং বিদ্ধি রাজসম্ ।। ২১ ৷৷
যে জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত প্রাণীতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আত্মা অবস্থিত বলে পৃথকরূপে দর্শন হয়, সেই জ্ঞানকে রাজসিক বলে জানবে।
যত্ন কৃৎস্নবদেকস্মিন্ কার্যে সক্তমহৈতুকম্। অতত্ত্বার্থবদপ্লং চ তত্তামসমুদাহৃতম্ ।। ২২ ।।
আর যে জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত তত্ত্ব অবগত না হয়ে, কোন একটি বিশেষ কার্যে পরিপূর্ণের ন্যায় আসক্তির উদয় হয়, সেই তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে কথিত হয়।
নিয়তং সঙ্গরহিতমরাগদ্বেষতঃ কৃতম্।
অফলপ্রেপ্সুনা কর্ম যত্তৎসাত্ত্বিকমুচ্যতে ।। ২৩ ৷৷
ফলের কামনাশূন্য ও আসক্তি রহিত হয়ে রাগ ও দ্বেষ বর্জনপূর্বক যে নিত্যকর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয়।
যতু কামেপ্সুনা কর্ম সাহঙ্কারেণ বা পুনঃ।
ক্রিয়তে বহুলায়াসং তদ্ রাজসমুদাহৃতম্ ।। ২৪ ।।
কিন্তু ফলের আকাঙ্ক্ষাযুক্ত ও অহঙ্কারযুক্ত হয়ে বহু কষ্টসাধ্য করে যে কর্মের অনুষ্ঠান হয়, সেই কর্ম রাজসিক বলে অভিহিত হয়।
অনুবন্ধং ক্ষয়ং হিংসামনপেক্ষ্য চ পৌরুষম্।
মোহাদারভ্যতে কর্ম যত্তত্তামসমুচ্যতে ।। ২৫ ৷৷
ভাবী বন্ধন, ধর্ম জ্ঞানাদির ক্ষয়, হিংসা এবং নিজ সামর্থ্যের পরিণতির কথা বিবেচনা না করে মোহবশত যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাকে তামসিক কর্ম বলা হয়।
মুক্তসঙ্গোহনহংবাদী ধৃত্যুৎসাহসমন্বিতঃ। সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোর্নির্বিকারঃ কর্তা সাত্ত্বিক উচ্যতে ।। ২৬।।
সমস্ত জড় আসক্তি থেকে মুক্ত, অহঙ্কারশূন্য, ধৃতি ও উৎসাহ সমন্বিত এবং সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে নির্বিকার- এরূপ কর্তাকেই সাত্ত্বিক বলা হয়।
রাগী কর্মফলপ্রেপ্সুলুব্ধো হিংসাত্মকোহশুচিঃ। হর্ষশোকান্বিতঃ কর্তা রাজসঃ পরিকীর্তিতঃ ।। ২৭ ৷৷
কর্মাসক্ত, কর্মফলে আকাঙ্ক্ষী, লোভী, হিংসাপ্রিয়, অশুচি, হর্ষ ও শোকযুক্ত যে কর্তা, সে রাজসিক কর্তা বলে কথিত হয়।
অযুক্তঃ প্রাকৃতঃ স্তব্ধঃ শঠো নৈষ্কৃতিকোহলসঃ।
বিষাদী দীর্ঘসূত্রী চ কর্তা তামস উচ্যতে ।। ২৮ ।।
অনুচিত কার্যপ্রিয়, জড় চেষ্টাযুক্ত, অনম্র, শঠ, অন্যের অবমাননাকারী, অলস, বিষাদযুক্ত ও দীর্ঘসূত্রী যে কর্তা, তাকে তামসিক কর্তা বলা হয়।
বুদ্ধের্ভেদং ধৃতেশ্চৈব গুণতস্ত্রিবিধং শৃণু। প্রোচ্যমানমশেষেণ পৃথক্ত্বেন ধনঞ্জয় ।। ২৯ ৷৷
হে ধনঞ্জয়! জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ অনুসারে বুদ্ধির ও ধৃতির যে ত্রিবিধ ভেদ আছে, তা আমি বিস্তারিতভাবে ও পৃথকভাবে বলছি, তুমি শ্রবণ কর।
প্রবৃত্তিং চ নিবৃত্তিং চ কার্যাকার্যে ভয়াভয়ে ।
বন্ধং মোক্ষং চ যা বেত্তি বুদ্ধিঃ সা পার্থ সাত্ত্বিকী ।। ৩০ ৷৷
হে পার্থ! যে বুদ্ধির দ্বারা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি, কার্য এ অকার্য, ভয় ও অভয়, বন্ধন ও মুক্তি – এই সকলের পার্থক্য জানতে পারা যায়, সেই বুদ্ধি সাত্ত্বিকী।
যয়া ধর্মমধর্মং চ কার্যং চাকার্যমেব চ। অযথাবৎ প্রজানাতি বুদ্ধিঃ সা পার্থ রাজসী ।। ৩১ ৷৷
যে বুদ্ধির দ্বারা ধর্ম ও অধর্ম, কার্য ও অকার্য আদির পার্থক্য অসম্যক্ রূপে জানতে পারা যায়, সেই বুদ্ধি রাজসিকী।