শ্রীভগবানুবাচ
অভয়ং সত্ত্বসংশুদ্ধিজ্ঞানযোগব্যবস্থিতিঃ।
দানং দমশ্চ যজ্ঞশ্চ স্বাধ্যায়স্তপ আর্জবম্ ।। ১ ৷৷ অহিংসা সত্যমক্রোধস্ত্যাগঃ শান্তিরপৈশুনম্।
দয়া ভূতেষ্বলোলুপ্তং মার্দবং হ্রীরচাপলম্ ।। ২ ৷৷
তেজঃ ক্ষমা ধৃতিঃ শৌচমদ্রোহো নাতিমানিতা।
ভবন্তি সম্পদং দৈবীমভিজাতস্য ভারত ।। ৩।।
পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে ভারত! ভয়শূন্যতা, সত্তার পবিত্রতা, পারমার্থিক জ্ঞানের অনুশীলন, দান, আত্মসংযম, যজ্ঞ অনুষ্ঠান, বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়ন, তপশ্চর্যা, সরলতা, অহিংসা, সত্যবাদিতা, ক্রোধশূন্যতা, বৈরাগ্য, শান্তি, অন্যের দোষ দর্শন না করা, সমস্ত জীবে দয়া, লোভহীনতা, মৃদুতা, লজ্জা, অচপলতা, তেজ, ক্ষমা, ধৈর্য, শৌচ, মাৎসর্য শূন্যতা, অভিমান শূন্যতা – এই সমস্ত গুণগুলি দিব্যভাব সমন্বিত ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়।
দম্ভো দর্পোহভিমানশ্চ ক্রোধঃ পারুষ্যমেব চ।
অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থ সম্পদমাসুরীম্ ।। ৪ ।।
হে পার্থ! দন্ত, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, রূঢ়তা ও অবিবেক- এই সমস্ত সম্পদ আসুরিক ভাবাপন্ন ব্যক্তিদের লাভ হয়।
দৈবী সম্পদ্ বিমোক্ষায় নিবন্ধায়াসুরী মতা।
মা শুচঃ সম্পদং দৈবীমভিজাতোহসি পাণ্ডব ।। ৫।।
দৈবী সম্পদ মুক্তির অনুকূল, আর আসুরিক সম্পদ বন্ধনের কারণ বলে বিবেচিত হয়। হে পাণ্ডুপুত্র! তুমি শোক করো না, কেন না তুমি দৈবী সম্পদ সহ জন্মগ্রহণ করেছ।
দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেহস্মিন্ দৈব আসুর এব চ।
দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু ।। ৬ ৷৷
হে পার্থ! এই সংসারে দৈব ও আসুরিক – এই দুই প্রকার জীব সৃষ্টি হয়েছে। দৈব সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এখন আমার থেকে অসুর প্রকৃতি সম্বন্ধে শ্রবণ কর।
প্রবৃত্তিং চ নিবৃত্তিং চ জনা না বিদুরাসুরাঃ।
ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে ।। ৭ ৷৷
অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা ধর্ম বিষয়ে প্রবৃত্ত এবং অধর্ম বিষয় থেকে নিবৃত্ত হতে জানে না। তাদের মধ্যে শৌচ, সদাচার ও সত্যতা বিদ্যমান নেই।
অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্। অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতুকম্ ।। ৮ ।।
আসুরিক স্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলে যে, এই জগৎ মিথ্যা, অবলম্বনহীন ও ঈশ্বরশূন্য। কামবশত এই জগৎ উৎপন্ন হয়েছে এবং কাম ছাড়া আর অন্য কোন কারণ নেই।
এতাং দৃষ্টিমবষ্টভ্য নষ্টাত্মানোহল্পবুদ্ধয়ঃ।
প্রভবন্তুগ্রকর্মাণঃ ক্ষয়ায় জগতোহহিতাঃ ।। ৯।।
এই প্রকার সিদ্ধান্ত অবলম্বন করে আত্মতত্ত্ব-জ্ঞানহীন, অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন, উগ্রকর্মা ও অনিষ্টকারী অসুরেরা জগৎ ধ্বংসকারী কার্যে প্রভাব বিস্তার করে।
কামমাশ্রিত্য দুষ্পূরং দন্তমানমদান্বিতাঃ।
মোহাদ্ গৃহীত্বাসগ্ৰাহান্ প্রবর্তন্তেহশুচিব্রতাঃ ।। ১০ ৷৷
সেই আসুরিক ব্যক্তিগণ দুপূরণীয় কামকে আশ্রয় করে দন্ত, মান ও মদমত্ত হয়ে অশুচি কার্যে ব্রতী হয় এবং মোহবশত অসৎ বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়।
চিন্তামপরিমেয়াং চ প্রলয়ান্তামুপাশ্রিতাঃ। কামোপভোগপরমা এতাবদিতি নিশ্চিতাঃ ।। ১১
আশাপাশশতৈর্বদ্ধাঃ কামক্রোধপরায়ণাঃ।
ঈহন্তে কামভোগার্থমন্যায়েনার্থসঞ্চয়ান্ ।। ১২ ৷৷
অপরিমেয় দুশ্চিন্তার আশ্রয় গ্রহণ করে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগকেই তারা তাদের জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। এভাবেই শত শত আশাপাশে আবদ্ধ হয়ে এবং কাম ও ক্রোধ-পরায়ণ হয়ে তারা কাম উপভোগের জন্য অসৎ উপায়ে অর্থ সঞ্চয়ের চেষ্টা করে।
ইদমদ্য ময়া লব্ধমিমং প্রান্স্যে মনোরথম্।
ইদমস্তীদমপি মে ভবিষ্যতি পুনর্ধনম্ ।। ১৩ ।।
অসৌ ময়া হতঃ শত্রুর্হনিষ্যে চাপরানপি।
ঈশ্বরোহহমহং ভোগী সিদ্ধোহহং বলবান্ সুখী ।। ১৪ ৷৷ আঢ্যোহভিজনবানস্মি কোহন্যোহস্তি সদৃশো ময়া। যক্ষ্যে দাস্যামি মোদিষ্য ইত্যজ্ঞানবিমোহিতাঃ ।। ১৫ ৷৷ অনেকচিত্তবিভ্রান্তা মোহজালসমাবৃতাঃ।
প্রসক্তাঃ কামভোগেষু পতন্তি নরকেহশুচৌ ।। ১৬।।
অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা মনে করে – “আজ আমার দ্বারা এত লাভ হয়েছে এবং আমার পরিকল্পনা অনুসারে আরও লাভ হবে। এখন আমার এত ধন আছে এবং ভবিষ্যতে আরও ধন লাভ হবে। ঐ শত্রু আমার দ্বারা নিহত হয়েছে এবং অন্যান্য শত্রুদেরও আমি হত্যা করব। আমিই ঈশ্বর, আমি ভোক্তা। আমিই সিদ্ধ, বলবান ও সুখী। আমি সবচেয়ে ধনবান এবং অভিজাত আত্মীয়স্বজন পরিবৃত। ও আমার মতো আর কেউ নেই। আমি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করব, দান করব এবং আনন্দ করব।” এভাবেই অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা অজ্ঞানের দ্বারা বিমোহিত হয়। নানা প্রকার দুশ্চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়ে এবং মোহজালে বিজড়িত হয়ে কামভোগে আসক্তচিত্ত সেই ব্যক্তিরা অশুচি নরকে পতিত হয়।
আত্মসম্ভাবিতাঃ স্তব্ধা ধনমানমদান্বিতাঃ।
যজন্তে নামযজ্ঞৈস্তে দম্ভেনাবিধিপূর্বকম্ ।। ১৭ ।
সেই আত্মাভিমানী, অনম্র এবং ধন ও মানে মদান্বিত ব্যক্তিরা অবিধিপূর্বক দম্ভ সহকারে নামমাত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে।
অহঙ্কারং বলং দর্পং কামং ক্রোধং চ সংশ্রিতাঃ। মামাত্মপরদেহেষু প্রদ্বিষন্তোহভ্যসূয়কাঃ ।। ১৮ ।
অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম ও ক্রোধকে আশ্রয় করে অসুরেরা স্বীয় দেহে ও পরদেহে অবস্থিত পরমেশ্বর স্বরূপ আমাকে দ্বেষ করে এবং সাধুদের গুণেতে দোষারোপ করে।
তানহং দ্বিষতঃ ক্রুরান্ সংসারেষু নরাধমান।
ক্ষিপাম্যজস্রমশুভানাসুরীষ্বেব যোনিষু ৷৷ ১৯ ৷৷
সেই বিদ্বেষী, ক্রুর ও নরাধমদের আমি এই সংসারেই অশুভ আসুরী যোনিতে অবিরত নিক্ষেপ করি।
আসুরীং যোনিমাপন্না মূঢ়া জন্মনি জন্মনি।
মামপ্রাপ্যৈব কৌন্তেয় ততো যান্ত্যধমাং গতিম্ ।। ২০৷৷
হে কৌন্তেয়! জন্মে জন্মে অসুরযোনি প্রাপ্ত হয়ে, সেই মূঢ় ব্যক্তিরা আমাকে লাভ করতে অক্ষম হয়ে তার থেকেও অধম গতি প্রাপ্ত হয়।
ত্রিবিধং নরকস্যেদং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ।
কামঃ ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতত্রয়ং ত্যজেৎ।। ২১ ।।
কাম, ক্রোধ ও লোভ – এই তিনটি নরকের দ্বার, অতএব ঐ তিনটি পরিত্যাগ করবে।
এতৈর্বিমুক্তঃ কৌন্তেয় তমোদ্বারৈস্ত্রিভির্নরঃ। আচরত্যাত্মনঃ শ্রেয়স্ততো যাতি পরাং গতিম্।। ২২ ৷৷
হে কৌন্তেয়! এই তিন প্রকার তমোদ্বার থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ আত্মার শ্রেয় আচরণ করেন এবং তার ফলে পরাগতি লাভ করে থাকেন।
যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ ।
এক ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্ ।। ২৩ ৷৷
যে শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করে কামাচারে বর্তমান থাকে, সে সিদ্ধি, সুখ অথবা পরাগতি লাভ করতে পারে না।
তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ।
জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি ।। ২৪
অতএব, কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। অতএব শাস্ত্রীয় বিধানে কথিত হয়েছে যে কর্ম, তা জেনে তুমি সেই কর্ম করতে যোগ্য হও।।