🌼 “দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ ।
ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কূটস্থোহক্ষর উচ্যতে ।।
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ ।
যো লােকত্রয়মাবিশ্য বিভৰ্ত্ত্যব্যয় ঈশ্বর ।।
যস্মাৎ ক্ষরাদতীতােহহং অক্ষরাদপিচোত্তমঃ । অতােহস্মি লােকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষােত্তম ।।”
“এই বিশ্বে দুইটি পদার্থ দৃষ্ট হয়—একটি ক্ষর, বিনাশশীল এই দৃশ্যমান জড় জগৎ ; অপরটি অবিনাশী, অপরিবর্তনশীল চৈতন্য। এই দুইটি ব্যতীত আর একটি পদার্থ আছে যাঁহাকে পরমাত্মা বলা হয়। তিনি সর্বভূতে অনুস্যুত হইয়া সর্বলােক ধারণ করিয়া আছেন। ক্ষর পদার্থের অতীত এবং অক্ষর হইতেও শ্রেষ্ঠ বলিয়া লােকে এবং বেদে আমি পুরুষােত্তম বলিয়া পরিচিত ।”
হিন্দুদর্শনে ব্রহ্ম সগুণরূপে তিন মূর্তিতে প্রকাশিত। এক অবিনাশী অনন্ত বিশ্বচৈতন্য, এবং বিশ্বের যাবতীয় পদার্থে এই অনন্ত চৈতন্যের প্রতিবিম্ব আভাসচৈতন্য এবং এই দৃশ্যমান জড়জগৎ।
এই আভাসচৈতন্য প্রত্যেক জড় বস্তুতে প্রতিফলিত হইয়া তাহাকে চৈতন্যময় করিয়া তােলে, তাহাতে ক্রমে ক্রমে মন, বুদ্ধি ও জ্ঞানের বিকাশ হয়। কিন্তু অনন্ত বিশ্বচৈতন্য ব্যতীত এই আভাসচৈতন্যের কোন পৃথক সত্তা নাই। অতএব আমরা চারিটি পদার্থের সন্ধান পাই। ব্রহ্ম,কূটস্থচৈতন্য, আভাসচৈতন্য এবং জড়জগৎ । এই চারিটি পদার্থের মধ্যে ব্রহ্ম আমাদের বর্তমান বিষয়ের বহির্ভূত। সেইজন্য আমরা অবশিষ্ট তিনটি পদার্থেরই আলােচনা করিব। বিশ্বচৈতন্য, বেদান্তে যাঁহাকে কূটস্থ (অর্থাৎ কূট—প্রতি অণু পরমাণুতে যিনি অবস্থিত) চৈতন্য বলা হয় তিনি সর্বব্যাপী, অবিনাশী, নিত্য অপরিবর্তনশীল, তিনি কখনও খণ্ড নন। এই অখণ্ড, অনন্তচৈতন্যের প্রতিভাসই আভাসচৈতন্য। এই আভাসচৈতন্য প্রতি খণ্ড খণ্ড অণু পরমাণুতে বিম্বিত হইয়া জড় প্রকৃতিকে চৈতন্যময়ী করিয়া তুলিয়াছে।
এই আভাসচৈতন্যের অনন্ত বিশ্বচৈতন্য ব্যতীত যদিও কোন পৃথক সত্তা নাই তথাপি ইহারই সাহায্যে প্রকৃতি জীবাণু হইতে মনুষ্য, দেবতা প্রভৃতি সৃষ্টি করিয়া স্বীয় স্বরূপ ভূমানন্দের সন্ধানে ক্রমে ক্রমে অভিব্যক্ত হইয়া আনন্দধামের দিকে চলিয়াছে। এই অখণ্ড অনন্ত বিশ্বচৈতন্যই গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। এই পুরুষােত্তম শ্রীকৃষ্ণই সাধকের লক্ষ্য ও অবলম্বন। গীতা পাঠ করিলে গীতার বহু অধ্যায়ের বহু শ্লোকেই শ্রীকৃষ্ণের এই স্বরূপের কথা আমরা বুঝিতে পারি। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনের ননীচোর রাধাবল্লভও নন, কিম্বা একজন কূটনীতিবিশারদ ক্রুর রাজনীতিজ্ঞও নন। তিনিই স্বয়ং পুরুষােত্তম ঈশ্বর ।।
★ শ্রীশ্রী স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বর গিরি প্রণীত “গীতার তত্ত্ব” থেকে সংগৃহীত ।