আজ সংসদে বা সংসদের বাইরে সংবিধানের কপি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ন্যায় বিচারের দাবি তুলছেন কংগ্রেসের ‘যুবরাজ’ রাহুল গান্ধী । অথচ তার দল ক্ষমতায় থাকার সময় বহু মানুষ অবিচারের শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে । কংগ্রেসের সৃষ্টি করা এমন কিছু আইন আছে যেগুলিকে ‘হিন্দু বিদ্বেষী’ বলে অভিহিত করা হয় । যাইহোক, রাহুল গান্ধীর জোট সঙ্গী সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদবও তার সুরে সুর মেলান । কিন্তু অখিলেশের বা তার বাবা মুলায়ম সিং যাদবের সময়ে উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্র পরিচালিত দুর্বৃত্তায়ন ঠিক কি পরিমাণ ছিল তার একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা আইএএস দুর্গা শক্তি নাগপালকে অপসারণের ঘটনা । এই ঘটনা আজম খান-এর নেতৃত্বে অখিলেশ যাদবের সরকার সমগ্র উত্তরপ্রদেশের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এটা খুব পুরনো ঘটনা নয়, মাত্র ১২ বছর আগের অর্থাৎ ২০১৩ সালের । গোটা রাজ্য জুড়ে ছিল মাফিয়াদের দাপট । বিশেষ করে ইউপির বালি ও খনি মাফিয়াদের দাপট ছিল সর্বজনবিদিত । আর অখিলেশ যাদবের সরকার মাফিয়াদের প্রচ্ছন্ন মদত দিত ৷ কারণ তারা ছিল সমাজবাদী পার্টির সদস্য এবং পার্টি ফান্ডের অর্থ যোগানদার । তারা অখিলেশের ভোট ব্যাংককে সুরক্ষিত রাখতে অর্থায়ন বা জিততে সহায়তা করার জন্য নৈরাজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করতে দুর্বৃত্তদের সরবরাহ করত বলে অভিযোগ ওঠে । চাকরি হারানোর ভয়ে আইএএস বা আইপিএস অফিসাররা চুপচাপ মুখ বুজে সব দেখে যেতেন । বিকল্প ছিলেন শুধু গৌতম বুদ্ধ নগরের সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট দুর্গা শক্তি নাগপাল । তিনি বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম মুখ বুঝে মেনে নেননি । আর গৌতম বুদ্ধ নগর জেলায় খনি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে জীবনের মারাত্মক ভুলটা তিনি করে ফেলেছিলেন । তার উপর মসজিদ স্থাপনের জন্য একটি নতুন কমপ্লেক্সের দেয়াল ভেঙে ফেলার নির্দিশ দেওয়ায় তিনি মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশের বিষ নজরে পড়ে যান । তার প্রতিদানও হাতেনাতে দিয়েছিলেন অখিলেশ । এই তরুণী আইএএস আধিকারিককে সাসপেন্ড করেছিলেন অখিলেশ যাদব ।
সমাজবাদী পার্টির নেতা নরেন্দ্র ভাটির একটা মন্তব্য আইএএস অফিসার দুর্গা শক্তি নাগপালের বরখাস্তের বিতর্ক আরও বাড়িয়ে দেয় । যখন তিনি বলেছেন যে তিনিই গৌতম বুদ্ধ নগরের সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটকে মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যে বরখাস্ত করেছিলেন । গ্রেটার নয়ডায় সমর্থকদের একটি সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে ভাটি বলেছিলেন, তিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব এবং সমাজবাদী পার্টির প্রধান মুলায়ম সিং যাদবের সাথে কথা বলেছেন এবং ৪০ মিনিটের মধ্যে শ্রীমতি নাগপাল তার বরখাস্তের আদেশ পেয়েছেন। তবে এনডিটিভির সাথে কথা বলতে গিয়ে, সমাজবাদী পার্টির নেতা বলেছেন যে তিনি জানেন না কখন শ্রীমতি নাগপালকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তিনি মিডিয়া থেকে এটি জানতে পেরেছেন । মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিপন্ন করার অভিযোগে আইএএস অফিসারকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন, যদিও একটি বিস্তারিত সরকারী তদন্তে দেখা গেছে যে এটি সত্য নয়।
এদিকে এই ঘটনায় তোলপাড় পড়ে যায় গোটা দেশের আইএএস মহলে । সমাজবাদী পার্টির দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা ওই তরুনী আইএএসকে বিনা অপরাধে এমন শাস্তি দেওয়ায় তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন ৷ শুধু উত্তরপ্রদেশই নয়,সারা দেশে জুড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় । আইএএস অ্যাসোসিয়েশন, আইপিএস অ্যাসোসিয়েশন, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য সচিব থেকে শুরু করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু ওই মহিলা আইএএস অফিসারের বরখাস্ত প্রত্যাহার করার পরিবর্তে, অখিলেশ যাদব তাকে চার্জশিট দেন।
এই পুরো পর্বে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যে গ্রেটার নয়ডার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রবিকান্ত নিজেই বিষয়টি তদন্ত করেছিলেন এবং একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন যেখানে তিনি স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন যে দুর্গা শক্তি নাগপাল মসজিদের দেয়াল ভেঙে ফেলার কথা তো দূরের কথা, এখনও পর্যন্ত সেখানে কোনও দেয়ালও তৈরিই করা হয়নি। শুধুমাত্র কথিত মসজিদ নির্মাণের জন্য সেখানে ভিত্তি খনন করা হচ্ছিল। সেই জমিটি ছিল সরকারি জমি এবং সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুসারে, কোনও সরকারি জমি দখল করে তার উপর ধর্মীয় স্থান নির্মাণ করা বেআইনি। সেই কারণেই দুর্গা শক্তি নাগপালকে দেয়াল ভাঙার জন্য অভিযুক্ত করা ভুল। দুর্গা শক্তি নাগপাল কেবল সেইসব লোকদের সতর্ক করেছিলেন যারা সরকারি জমিতে ধর্মীয় স্থান নির্মাণের চেষ্টা করছিলেন।
একজন কথিত নামাজবাদী মুখ্যমন্ত্রীর একগুঁয়েমি এবং প্রকাশ্য তোষণের কারণে, আইএএস অ্যাসোসিয়েশন, সমগ্র আমলা লবি, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট এমনকি প্রধানমন্ত্রীও অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীরও কোনও পদক্ষেপ ছিল না, কারণ অখিলেশের বাবা মুলায়মই ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সংখ্যালঘু ইউপিএ সরকারকে পতন থেকে বাঁচিয়েছিলেন।
গৌতম বুদ্ধ নগরে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে ছয় মাসে ২৮ বর্ষীয়া মিসেস নাগপাল ৩০ ট্রলি অবৈধভাবে উত্তোলিত বালি বাজেয়াপ্ত করেন। পাশাপাশি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে দুই কোটি টাকার জরিমানা জারি করা হয় । অবৈধ বালি উত্তোলনের জন্য শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে কয়েকজনের সমাজবাদী পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল । যেকারণে অবৈধ খনির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং উত্তর প্রদেশের শক্তিশালী বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া নাগপালকে রাজ্যে প্রথম পোস্টিং পাওয়ার মাত্র ১০ মাস পরেই বরখাস্ত করা হয়েছিল।
দুর্গা শক্তি নাগপাল ছিলেন ২০০৯ ব্যাচের আইএএস অফিসার,তিনি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে গৌতম বুদ্ধ নগরের সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট (এসডিএম) হিসেবে নিযুক্ত হন। বিতর্কিত উপাসনালয়ে দেয়াল ভাঙার জন্য ২৮ বছর বয়সী এই মহিলাকে দৃশ্যত শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। সমাজবাদী পার্টি সরকারের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিরোধী দলগুলি অভিযোগ করেছে যে খনি মাফিয়াদের চাপে এই বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এসডিএমের বরখাস্তের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিজেপি নেতা কলরাজ মিশ্র বলেছিলেন যে রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তারা মাফিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকারী অফিসারদের পছন্দ করছে না । তিনি বলেছিলেন, ‘নাগপাল কী ভুল করেছেন?… এটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে যে তাকে (দুর্গা শক্তি) মাফিয়াদের প্রভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে ।’
উল্লেখ্য,পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের যমুনা ও হিন্ডন নদীর চর থেকে বেপরোয়া বালি উত্তোলনের ফলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় । তা বন্ধে দুর্গা শক্তি নাগপাল বিশেষ উড়ন্ত স্কোয়াড গঠন করেছিলেন। এক কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেছিলেন যে অননুমোদিত ড্রেজারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না।
ওই কর্মকর্তা বলেছিলেন,পুরো জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অবৈধ খনন একটি বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে । ঝুঁকি অনেক বেশি এবং জড়িতরা বিপুল আর্থিক লাভ পায়। এই আইন গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং তাই এটি বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল ।’
পাঞ্জাব ক্যাডারের একজন আইএএস অফিসার, মিসেস নাগপাল অবৈধ খননে জড়িত ২৪টি ডাম্পার বাজেয়াপ্ত করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যার ফলে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। নয়ডা অঞ্চলে বালি মাফিয়াদের অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধে তার নির্বোধ, কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি আলোচনায় এসেছিলেন । আর তার এই অপরাধে অখিলেশ সরকারের শাস্তির মুখে পড়তে হয় তাকে ।।