ছোট্ট এক চিলতের টালির চালের ঘর। পোস্ট অফিসের চাকরি টা পেলো কিন্তু একেবারেই গ্রামের এক জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি এলাকায়।
আজ ডাকঘরের লেটার বাক্সে একটা চিঠি এসেছে। চিঠির বিষয়বস্তু কিছুটা এমন,….’ তুমি কি চাকরি পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে?….তুমি খালি তোমার গ্রামের মালবিকার কথা ঘুরে ফিরে চিঠিতে লেখো আমার কাছে। কিন্তু আমার কথা কম লেখো । …. পুজো আসতে চলেছে। কবে আসবে?….আর কবে আমার মা,বাবার সাথে কথা বলবে?…..ওনারা যে আমার সম্বন্ধ দেখছেন।…..কবে আসবে?…..না কি মালবিকা তোমার এখন নতুন চিঠির খাম?’
……..পাহাড়ি জঙ্গলের পূর্ব দিক করে এক নদীর ধারে কাশ ফুলের সারি। শারদের আকাশে শ্বেত শুভ্র মেঘবতী কন্যাদের নানা রূপের আলিঙ্গন। নৌকা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে গ্রামের কয়েকটা চিঠি বিলি করেই কৌশিক পিচ রাস্তায় ধরবে শহরে যাওয়ার জন্যে। হাতে একটা তিন ফুট দৈর্ঘ্যের পেইন্টিং। পেপারে মোড়া।
পাঁচ ঘন্টার পথ পেরিয়ে কৌশিক সোজা পিউর বাড়ির দালানে উঠেছে আজ। পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলে তখন মহালয়ার গান বাজচ্ছে।…..’বাজলো তোমার আলোর বেণু মাতলো রে ভুবন
বাজলো তোমার আলোর বেণু।’…….কৌশিক কিছুটা সংকোচন সহকারে পিউর বাড়ির দালানে দাঁড়িয়ে ডাকতে থাকলো কাকাবাবু…..কাকাবাবু…..বাড়িতে আছেন ?…..ভেতর থেকে একটু ভারী মাঝ বয়সী পুরুষের গলার স্বর এলো ‘কে?….কে?’….’আজ্ঞে আমি কৌশিক।’….চশমা টা চোখে পরতে পরতে আধাকাঁচা মাথার চুলে গাল ভর্তি দাড়ির মানুষ, বেরিয়ে এলেন বাড়ির দালানে।
আজ্ঞে কাকাবাবু ‘আমি একটা পোস্টমাস্টার এর চাকরি পেয়েছি। আপনার সাথে বহুদিন দেখা হয় নি। আপনার আশীর্বাদ নিতে এলাম।’…..বলেই কৌশিক পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। আর হাতের তিন ফুট দৈর্ঘ্যের একটা ছবি উপহার হিসেবে তুলে দিলেন পিউর বাবার হাতে। তারপরে আসছি বলেই। চলে যাওয়ার সময়ে একবার তাকালো পিউর দিকে। পিউর চোখমুখের ভীষণ দ্বিধা দ্বন্দ্ব কপালের ঘাম হয়ে গাল ভেজালো।….আজও কৌশিক ওর বাবার কাছে তাদের দুজনের বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারলো না। কিছুই বলতে পারলো না।
পিউর বাবা পেপারে মোড়া পেইন্টিং পিউর মা এর হাতে দিয়ে বললেন,’এটা আমার ঘরে রেখে দাও। আমি দত্ত বাবুর বাড়ি যাবো। ওনার ছেলের জন্যে কথা বলতে।’
পিউর মা সেই কথা মতো কাজ করে, গেলেন রান্না ঘরে। দুপুরে বাড়ির সকলের আহারাদির পরে, নিজ ঘরে গিয়ে পেইন্টিং খুললেন মলয় বাবু।…..কৌশিক কখনই যা মুখ ফুটে মলয় বাবুকে বলতে পারে নি। ছবিটি তার নিজের আঁকা। নিজের হৃদয়ের কথ্যভাষা। এ এক অন্য কাব্যগ্রন্থের পাতায় বেঁধে ছিলো দুই হৃদয়কে ঠিক এভাবে, ” যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ।।”