প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৮ অক্টোবর : ভারতীয় সংস্কৃতিতে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যেকার সম্পর্ক আজও বিশেষ মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত রয়ে আছে।সেই মর্যাদাকে মান্যতা দিয়ে অবসর গ্রহনের পরেও নিঃস্বার্থে পড়ুয়াদের পাঠ দানে অবিচল রয়েছেন পূর্ব বর্ধমান জেলার তিন শিক্ষক । মহতি ওই তিন শিক্ষক হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ,তাপস কার্ফা এবং অরুণ দে।এঁনারা শুধুমাত্র সুশিক্ষিত ছাত্র সমাজ গড়ার গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য আজও নিয়মিত পৌছে যান স্কুলে।পড়ুয়াদের কাছে টেনেনিয়ে তাঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে পাঠ দেন ।এমন ’মাহাত্মের’ দৌলতে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে জেরবার বঙ্গে এই তিন শিক্ষক কার্যতই যেন আদর্শ শিক্ষকের পরিচায়ক বনে গিয়েছেন ।
শিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অবদান আজও স্নরণ করেন পূর্ব বর্ধমান জেলাবাসী।এমন এক জেলার জামালপুর ব্লকের পাড়াতল ১ গ্রাম পঞ্চায়েতর অন্তর্গত বসন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ।রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইংরেজিতে মাস্টার ডিগ্রী করা দ্বিজেন বাবু দীর্ঘ ২৮ বছর জামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ২০০৮ সালে তিনি শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নেন।তিনি যখন শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নেন সেই সময়ে বসন্তপুর গ্রামের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা লাভের ভরসা বলতে ছিল একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। আশপাশেও ছিল না কোন জুনিয়র হাই স্কুল বা হাই স্কুল। তাই লেখাপড়া শেখার জন্য বসন্তপুর ও তার সংলগ্ন বেত্রাগড়,সজিপুর সহ একাধীক গ্রামের ছেলে মেয়েদের পাঁচ কিলোমিটার দূরে জামালপুর অথবা সেলিমাবাদ হাই স্কুলে যেতে হত।এই দূরত্ব স্কুল বিমুখ করে তুলছিল এলাকার দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর পরিবারের ছেলে মেয়েদের।
এই বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয় কে। তিনি তাঁর গ্রামে একটা জুনিয়র হাই স্কুল গড়ার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নেন । তার জন্যে ২০১০ সালের প্রথম থেকে শুরু হয় তাঁর লড়াই। সেই লড়াইয়ে তিনি পাশে পান গ্রামের মানুষজন এবং তদানিন্তন জামালপুর ব্লকের স্কুল পরিদর্শক (এস আই) সমরেশ দাস মহাশয়কে। ওই বছরের জুন মাসে শিক্ষা দফতর থেকে বসন্তপুর গ্রামে জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার সবুজ সংকেত মেলে।সরকারী অর্থে সরকারের অনুমোদন করা জমিতে তৈরি হয় স্কুল ঘর।ছাত্র ছাত্রীদের পাঠ দানের জন্য চারজন গেস্ট টিচারও মেলে।তার সঙ্গে দ্বিজেন বাবুও নিঃস্বার্থে স্কুলের ছেলে মেয়েদের পাঠদান করে চলেন ২০১৮ সালে বিদ্যালয়ের জন্য তিনজন স্থায়ী শিক্ষক অনুমোদন হলেও স্থায়ী শিক্ষক আজও মেলে নি।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে গেস্ট টিচাররাও একে একে অবসর নিয়ে স্কুল ছাড়েন।শিক্ষকের আকালের কারণে বছর চার আগে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।এই অবস্থায় স্কুলে তালা পড়া আটকাতে দ্বিজেন বাবুর অনুরোধে বেতনের প্রত্যাশা না করে সুমন মাঝি,শ্বাগতা ঘোষ,শিল্পা সাহা,সহেলি মণ্ডল ,বিশ্বজিৎ মিত্র নামে পাঁচ উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী স্কুলের পড়ুয়াদের পাঠদানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন । স্কুল বাঁচাতে আজও তাঁদের সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গত দিয়ে চলেছেন ৮০ ছুঁই ছুঁই বয়সী দ্বিজেন ঘোষ। তাঁর এই কর্মকাণ্ডকে প্রতিনিয়ত কুর্নিশ জনান বসন্তপুর গ্রামের পড়ুয়া থেকে শুরু করে বাসিন্দারা ।
দ্বিজেন বাবুর মতই অপর দুই পড়ুয়া ও স্কুল দরদি শিক্ষক হলেন কালনা শহরের কাঁসারীপাড়ার বাসিন্দা তাপস কুমার কার্ফা এবং রায়নার বুলচন্দ্রপুর গ্রাম নিবাসী অরুণ কুমার দে । দু’জনেই কাগজে কলমে শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন।কিন্তু দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন কাটানো স্কুল থেকে অবসর লাভের পরেও তাঁরা শিক্ষা দানের আদর্শ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি।
কালনার মহারাজা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন শিক্ষারত্ন পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক তাপস কার্ফা । জীববিজ্ঞানের শিক্ষক তাপস বাবু ২০২২ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর অবসর নেন। তবু আজও তিনি নিয়ম করে স্কুলে পৌছে যান নিঃস্বার্থে স্কুলের পড়ুয়াদের পাঠদান করতে । পড়ুয়া অন্ত প্রাণ তাপস কার্ফা কালনা মহারাজা উচ্চ বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে দু-লক্ষ টাকা দানও করেছেন। শুধু শিক্ষা দানই নয় ,তাপস বাবু গ্রামে গ্রামে গিয়ে ডাইন-প্রথা সহ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতায় প্রচারও চালান।
একই ভাবে পড়ুয়া দরদি শিক্ষক হিসাবে রায়নার নাড়ুগ্রাম পঞ্চায়েতের দুলইদিঘি গ্রামের আপামোর বাসিন্দার মনের মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে অরুণ দে। দলুইদিঘি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করে তিনি অবসর গ্রহন করেন । কিন্তু অবসর নিলে কি হবে,নিজের কর্মজীবনের স্কুল ও স্কুলের পড়ুয়াদের ছেড়ে থাকতে তিনি পারেন নি । তাই অবসর নেওয়ার পরেও নিঃস্বার্থে পড়ুয়াদের পাঠ দান করতে অরুণ দে প্রতিদিন পৌছে যান দলুইদিঘি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ই যেন তাঁর ধ্যান জ্ঞান। বিদ্যালয়ের প্রথান শিক্ষক বিদ্যুৎ হাজরা বলেন,’পড়ুয়া দরদি শিক্ষক হিসাবে অরুণ দে বিদ্যালের পড়ুয়াদের পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দাদেরও মনের মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে পড়ুয়া, এলাকাবাসী অবিভাবকদের গর্বের শেষ নেই। জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ শান্তনু কোঙার বলেন, এই তিন শিক্ষক আমাদের জেলার গর্ব।সুশিক্ষিত ছাত্র সমাজ গড়ার লক্ষে ওনারা যেভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যি অনবদ্য। ওনাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে ।।