প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৮ মার্চ : প্রশাসনকে ধোঁকা দিতে নিত্যদিন বালি পাচারের কৌশল বদলাচ্ছে বালি মাফিয়ারা। তারা কোন সময় ‘বিশ্ববাংলা লোগো’ সমেত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট সুরক্ষা কমিটি’র নাম দেওয়া প্যাডের পাতা দেখিয়ে ওভারলোডিং করে বালি আর পাথর পাচারে নেমে পড়ছে । আবার কখনও তারা ভূয়ো ই-চালান ব্যবহার করে বালি পাচারের কৌশল নিচ্ছে । তবে পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের তৎপরতায় মাফিয়াদের সব কৌশলেরই পর্দা ফাঁস হয়ে গিয়েছে । এবার মাফিয়া চক্রের একের পর এক পান্ডাকে জালে পুরছে পুলিশ। একই সঙ্গে চলছে এইসব চক্রের আঁতুড় ঘরের খোঁজ ।
রীতিমতো অফিস খুলে জেলার জামালপুর থানার আঝাপুরে জাতীয় সড়ক সংলগ্ন এলাকায় তৈরি হত বালি পরিবহনের জাল ই-চালান । কাছাকাছি এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও পুলিশের কেউ তা টেরও পায়নি । বিষয়টি সামনে আসে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে কাড়ালাঘাট মোড়ের কাছে পুলিশ পাঁচটি বালিবাহী লরি আটকানোর পর শুরু হওয়া তদন্তে । পুলিশের কথায়,ওইদিন ৫টি লরি রায়নার বাঁধগাছা হয়ে কাড়ালাঘাট-শাহহোসেনপুর রোড ধরে আসছিল । কাড়ালাঘাট মোড়ের লরিগুলিকে আটকানোর পর চালকরা পুলিশকে ই-চালান দেখিয়ে লরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলে । চালানগুলি দেখে সেগুলি আসল না নকল তা নিয়ে পুলিশ ধন্দে পড়ে যায় । পুলিশ চালানগুলি বাজেয়াপ্ত করে লরির নম্বর ও চালকদের ছবি তুলে রাখে । চালানগুলি পরীক্ষা করার জন্য জামালপুরের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরে পাঠায় পুলিশ। ই-চালানগুলি জাল বলে কিছুদিন পর ভূমি দপ্তর পুলিশকে জানায়। এর পরেই পুলিশ তদন্তে নেমে রায়নার বামুনিয়া নিবাসি লরি চালক শেখ তাজউদ্দিন,মেমারির নিমো নিবাসী লরি চালক শ্রীমন্ত বাগদি এবং জামালপুরের সেলিমাবাদ ও চক্ষণজাদি নিবাসী দুই লরি চালক চঞ্চল মণ্ডল ও আব্বাসউদ্দিন মল্লিক কে পর পর গ্রেফতার করে । ধৃত লরি চালকদের বর্ধমান আদালতে পেশ করে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে পুলিশ চক্রের কাজ কারবারের বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারে। চঞ্চলের কথায় পুলিশ জানতে পারে আঝাপুরে অফিস খুলে চলছে বলির জাল ই-চালান তৈরি ।
এমনটা জানার পরেই পুলিশ জাল ই- চালান তৈরির অফিসে হানা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ফেলে । সেই মত পুলিশ ধৃত চঞ্চল মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে আঝাপুরের ওই অফিসে হানা দিয়ে স্বাগতম পাণ্ডেকে গ্রেপ্তার করে । পুলিশের
দাবি স্বাগতমের কাছ থেকে বেশকিছু জাল ই-চালান, কম্পিউটার, সিপিইউ ও প্রিন্টার উদ্ধার হয়েছে। ধৃতকে শুক্রবার বর্ধমান সিজেএম আদালতে পেশ করা হয়। আরও জাল ই-চালান এবং তা তৈরিতে ব্যবহৃত কম্পিউটার উদ্ধার করতে ও চক্রের বাকিদের হদিশ পেতে ধৃতকে ৭ দিন নিজেদের হেফাজতে নিতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানায় পুলিশ । সিজেএম ধৃত স্বাগতম পাণ্ডেকে ৫ দিনের পুলিশি হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন । তবে শুধু জাল ই-চালান তৈরি করে বালি পাচার নয়। বিশ্ববাংলা লোগো দেওয়া ‘ওয়েস্টবেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট সেফটি কমিটি’র নাম দেওয়া প্যাডের পাতা দেখিয়ে ওবারলোডিং বালি ও পাথর
পাচার চক্রের পর্দাও পুলিশি তদন্তে ফাঁস হয়েছে।
পুলিশ কর্তাদের কথায়,গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপর থাকা ‘চেক পোষ্টে’ কর্মরত পরিবহন দপ্তরের আধিকারিকরা গাড়ির নথি পরীক্ষা করে তারপর গাড়ি ছাড়ছিলেন
। ওই সময় বীরভূমের ইলামবাজার থেকে কলকাতা মুখী একটি ট্রাকের চালক বিশ্ববাংলার ‘লোগো’ দেওয়া প্যাডের পাতা বের করে পরিবহণ দফতরের ইন্সপেক্টরকে দেখায় । সন্দেহ হওয়ায় ইন্সপেক্টর ওই প্যাডের পাতাটি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান । জালিয়াতি করে এমন প্যাড কেউ তৈরি করেছে বলে নিশ্চিত হবার পর রাজ্যের পরিবহণ দফতর জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে তদন্ত করে এফআইআর করার নির্দেশ দেয়।
পরিবহন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে,জেলার পরিবহন আধিকারিক অনুপম চক্রবর্তী উত্তর ২৪ পরগণার বসিরহাট নিবাসী ওই ট্রাকের মালিক অভিজিৎ ঘোষ ও চালক শুভদীপ বিশ্বাসকে ডেকে পাঠিয়ে জবানবন্দী নেন । তাঁদের কাছ থেকে পরিবহণ দফতরের কর্তারা জানতে পারেন, বসিরহাটের নাজিমুল ইসলামের কাছ থেকে তাঁরা প্যাডের পাতাটি কিনেছিল। প্রতিটি পাতার দাম পড়েছিল ২৫ হাজার টাকা করে । ওই প্যাড থাকলে ১০ টন পর্যন্ত অতিরিক্ত পণ্য বহন করার ‘অধিকার’ ট্রাকের চালক পাবে বলে তাঁদের বলা হয়েছিল । এমনটা জানার পর দফতরের ইন্সপেক্টর কয়েকদিন আগে শক্তিগড় থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, মূল অভিযুক্ত নাজিমুল মুম্বইয়ের বসিতে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। জেলা পুলিশের বিশেষ দল সেখান থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে ‘ট্রানজিট রিমান্ডে’ বর্ধমান নিয়ে আসছে। জেলার পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন বলেন,’নাজিমুলকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্তারিত জানা হবে ।’।