ফ্যাক্টরির কাজ শেষ হতে হতে সেদিন কিছুটা দেরী হয়েছিল আমার। মাঝে মাঝে তেমনটা হয় না বললে মিথ্যে বলা হবে। তবে সেটাকে ওভারটাইম বলেই ধরা হয়। শেষ বাসটা তো আছেই, তাই এতটা তোয়াক্কা করি নি। ওভারটাইম করে ক ‘ টাকা বেশি পেলে ক্ষতি কী? তেমনি সে রাতেও শেষ বাসে চড়ে বাড়ি ফিরছিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সে রাতে রাস্তায় গাড়িটা বিকল হয়ে যায়। এত রাতে কোন মেকানিক পাওয়া যাবে না। তাই যাত্রীরা যে যার মত করে গাড়ি ভাড়া করে ফিরে গেল। সেই মুহূর্তে আমাকে আমার গ্রামের রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার জন্য, একমাত্র উপায় প্রাইভেট গাড়ি। তাছাড়া আর অন্য কোন উপায় নেই। আমি পড়লাম মহা বিপদে। একে মাসের শেষ, তাছাড়া ভাড়া করে যাওয়ার মত পর্যাপ্ত টাকাও ছিল না আমার পকেটে। কুসুম গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে আমাদের বাড়ি। একে গ্রাম, তার উপর সরু মেঠো পথ, সেদিকে কোন গাড়িও যেতে পারে না। তাই দু ‘ক্রোশ পথ হেঁটেই পার করতে হয়। হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলাম, প্রায় বারোটা বাজতে দু’এক মিনিট বাকি। অমাবস্যার রাত, চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেন যে আজই গাড়িটা খারাপ হতে গেল! অকস্মাৎ ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল। নাহ্, এখন আর থেমে থাকলে তো চলবে না! দ্রুত পা চালাতে হবে। ভাবা মতই দ্রুত গতিতে চলা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘ গর্জন শুরু হল। শো শো করে হাওয়াও প্রবল গতিতে তার গতি বৃদ্ধি করতে লাগল। দূরে ক্ষীণ আলোয় জ্বলে থাকা লাইট পোস্টের আলোটাও চট করে নিভে গেল। কোন দিকেই কিছু ঠাউর করা যাচ্ছে না। মেঠো পথ দিয়ে অস্থির মন নিয়ে চলছি একা আমি। গাছের পাতা ছুঁয়ে হাওয়া তার ভুতুড়ে স্বরে বাঁশি বাজাচ্ছে। গা ছমছম করছে। তবুও সাহসের সাথেই এগিয়ে যাচ্ছি। জানি না কতক্ষণে গিয়ে বাড়ি পৌঁছব। এখানে মোবাইলের কোন নেটওয়ার্ক নেই। তাই কারো সাথে যোগাযোগ করাও অসম্ভব। দু ‘ ধারে ধূ ধূ মাঠ। মাঝে মাঝে জঙ্গল পথ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চেনা পথটাও অচেনা লাগছে আমার। হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করে একটা খেচর উড়ে গেল। আমার গা টা কিঞ্চিৎ শিউরে উঠল। নিজেকে সামলে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। থামি নি তবুও। সাহস সঞ্চয় করে যতটা পারি চলার গতি বাড়াতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল, ম্যারাথন রেসে ছুটছি আমি। দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে যাচ্ছে তার দাপট স্বরে ‘হুক্কা হুয়া ‘। তেমনি শুনতে পাচ্ছি ঝি ঝি পোকার ডাক। আশেপাশে কোথাও লোকালয়ের কোন চিহ্নমাত্রও নেই। চারিদিকে শুধুই ঘোর অন্ধকার।
হঠাৎ কারও গলার স্বর শুনতে পেলাম। পেছন থেকে যেন কেউ ডাকছে,
— শোভন .. এই শোভন, আরে থাম।
কণ্ঠস্বরটা খুব চেনা লাগল। এটা তো সমীরের আওয়াজ! হ্যাঁ, একদমই তাই।
পেছন ঘুরতেই দেখলাম দৌড়ে আমার দিকেই কেউ একজন ছুটে আসছে।
আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। যাক এই দুর্যোগ রাতে একজনকে অন্তত পথের সাথী করে পেলাম। অন্ধকারে মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। তবে আওয়াজে বাল্যসখাকে চিনতে অসুবিধে হ’ল না।
— আরে সমীর যে! তুই কবে এলি ?
— এই তো আজই। এদিকে একটা গাড়িটা মোড়ে ছেড়ে দিল।
— যাক্ ভালই হ’ল। চল্ তোর শহরের কথা শুনতে শুনতে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাই।
— তুই বল, কেমন আছিস? অনেকদিন কোন যোগাযোগ নেই। কী করছিস আজকাল?
— আমার কথা আর কী নতুন রে! সেই একই কারখানায় কাজ করছি রে! তুই তো দিল্লিতে ভালো কাজ করছিস শুনেছি। ভালই তো। বাবু বনেছিস। আমি তো সেই সামান্য মজদুরই রয়ে গেলাম।
— সে যাই বল, বন্ধু তো আমরা! কাজে কী এসে যায় রে!
বলতে বলতে সমীর আমার হাতটা ধরল।
— একি! তোর হাতটা এতো ঠাণ্ডা কেন রে সমীর?
— আরে এই দেখ কোল্ড ড্রিংকস খাচ্ছিলাম। তাই ।
— ও আচ্ছা।
কিছুক্ষণ দুজনে চুপ করে চলছিলাম।
যেতে যেতে সমীর আবার বলে উঠল।
— শোন, শোভন, কাল তো রবিবার। সকালে একবার আমার বাড়িতে আসতে পারবি?
— ঠিক আছে, যাবো।
— শোন, আমার বাবাকে একটা কথা বলতে পারবি?
— কেন? তুই তো বাড়ীতেই যাচ্ছিস।
— আরে কথাটা তোকে বলতে হবে শোভন। প্লিজ মনে করে বলিস।
— আচ্ছা ঠিক আছে বল, আমাকে কি বলতে হবে?
— কথা দিয়েছিস কিন্তু বন্ধু। বলতে তোকে হবেই।
— ভনিতা না করে বল দেখি এবার!
— বেশ শোন, বাবাকে বলবি, আমার মামাতো ভাই কাজল, যে আমার সাথে কাজ করে। সে আমার জায়গা নেওয়ার জন্য, আমাকে গলা টিপে মেরে ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমি আত্মহত্যা করিনি। আমাকে খুন করা হয়েছে। আমার রুমের আলমারির কোণায় ক্যামেরা ফিট করা আছে। ওখানে সব প্রমাণ পেয়ে যাবে। তুই সেকথা বাবাকে বলিস। বন্ধু হয়ে আমার জন্য এইটুকু করিস প্লিজ।
সমীরের উৎকট কথা শুনে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এ কি বলছে ও?! আমার শ্বাসরোধ হওয়ার অবস্থা তখন। অকস্মাৎ হৃদস্পন্দন যেন তীব্র গতিতে বেড়ে গেলো। নিজেই নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম সেই মুহূর্তে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। কোনোমতে আমার মুখে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো ,
—- কি…!! ??? তু….ই তা…হ….লে… !!!
— হ্যাঁ রে… আমি এখন তোদের মতো মানুষ নেই…
হঠাৎ তীব্র এক ঝড়ো বাতাস এসে আমাকে যেন সজোরে ধাক্কা দিয়ে গেল। হাত পা কাঁপছিল তখন আমার। সাহস গুটিয়ে আমি পাশ ঘুরে সমীরকে দেখতে গেলাম। নাহ্, কেউ কোথাও নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে আমার চারপাশটা। এ আমি কোথায়?! এটা তো একটা শ্মশান বলে মনে হচ্ছে! তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে বাড়ির খাটে আবিষ্কার করলাম। সমস্ত শরীর দিয়ে তখনও অঝোরে ঘাম ঝরছে আমার।
এটা তাহলে কী স্বপ্ন ছিল! আজ তো শনিবার! বাড়ীর কাজের জন্য শুক্র, শনি এই দুদিন ছুটি নিয়েছিলাম। তাহলে ? কাল রবিবার… সমীর বলছিল, রবিবার ওদের বাড়িতে যেতে। স্বপ্নটা কেমন যেন রহস্যময় লাগছে!