কংগ্রেসের জাতপাতের রাজনীতি আজকের নয়, বহুদিনের । আজ ‘জাত সুমারি’ নিয়ে জোরদার সওয়াল করা রাহুল গান্ধীর দল প্রায় তিন দশক আগে গান্ধীবাদী সীতারাম কেশরীর মত একজন অনগ্রসর শ্রেণীর নেতার কি অবস্থা করেছিল, শুনলে আপনার চোখে জল চলে আসবে! ভিপি সিং মন্ডল কমিশন বাস্তবায়নের ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু সীতারাম কেশরীর স্বাক্ষরে ২৭ শতাংশ ওবিসি কোটা বাস্তবায়িত হয়েছিল। এক সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ছিলেন সীতারাম কেশরী । ১৯৭০ সালে কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটলে বিহার কংগ্রেসের তথাকথিত উচ্চবর্ণের প্রবীণ নেতারা কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কংগ্রেসে অনগ্রসর শ্রেণীর নেতাদের মর্যাদা কিছুটা বেড়ে যায় । এমন পরিস্থিতিতে সুযোগ পেলেন কেশরীও । ১৯৭৩ সালে, তিনি দীর্ঘকাল বিহার কংগ্রেস কমিটির সভাপতি এবং পরে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যরা দীর্ঘদিন সংসদীয় জীবনে ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন, যেখানে তিনি ১৯৯৮ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত ছিলেন। অপমানজনকভাবে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে । সীতারাম কেশরীর সেই বেদনাদায়ক কাহিনী নিয়ে আলোচনা করব।
সীতারাম কেশরী ১৯১৯ সালে বিহারের দানাপুরে কেশরওয়ানি বানিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষারও আয়োজন ছিল না। দানাপুর হল পাটনার কাছে একটি ছোট শহর, যা আজকাল কার্যত পাটনা শহরের একটি অংশ। এখানে আর্য সমাজের ভালো প্রভাব ছিল এবং কথিত আছে যে একবার দয়ানন্দ সরস্বতী এখানে এসেছিলেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে দানাপুর সেনানিবাসের ২৫০০ সৈন্য একসাথে বিদ্রোহ করে। বিংশ শতাব্দীতে জাতীয় আন্দোলনের গান্ধী যুগ শুরু হলে দানাপুরের বহু মানুষ এতে অংশ নেন । কথিত আছে যে সীতারাম কেশরী ১৯৪০ সালের রামগড় অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সম্ভবত কংগ্রেস সেবাদলের ড্রাম-পার্টির অংশ ছিলেন । কয়েকবার কারাগারেও গেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন । সেই সময়েও বিহারের কংগ্রেসের রাজনীতি বর্ণবাদে ভরপুর ছিল। ভূমিহার ও রাজপুতরা প্রভাবশালী ছিল।কায়স্থরা তৃতীয় অবস্থানে এবং ব্রাহ্মণরা চতুর্থ অবস্থানে ছিল । পুনা চুক্তির কারণে দলিতদের সংরক্ষণের কারণে দলিতদের কিছু নেতা জায়গা পেয়েছিলেন । আদিবাসী জয়পাল সিং মুন্ডা অবশ্যই কংগ্রেসে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, কিন্তু ১৯৬৩ সালে তিনি কয়েকদিন উপ-মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এত কিছুর মধ্যেও কংগ্রেসে অনগ্রসর শ্রেণীর নেতাদের স্থান ছিল না। সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দিয়ে পশ্চাদপদ শ্রেণীর লোকেরা রাজনীতি করতেন। যাইহোক, পূর্ণাঙ্গ দ্বিজ নেতাদের একটি সমাবেশও ছিল । এই সমাজতান্ত্রিক দ্বিজরা তাদের বক্তৃতায় বিপ্লবী ছিলেন, কিন্তু তাদের অভ্যন্তরীণ আচরণে কম বর্ণবাদী ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতেও কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন কিছু নেতা। সীতারাম কেশরী ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। এই নেতারা সম্ভবত কখনও কখনও পরিবর্তন আশা করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে এমন একটি পরিবর্তন আসে যখন কৃষ্ণবল্লভ সহায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হন। এরপর মোট এগারো সদস্যের মন্ত্রিসভায় তিনজন অনগ্রসর শ্রেণি, একজন দলিত, একজন অনগ্রসর এবং একজন অগ্রগামী মুসলিম এবং একজন উপজাতি মন্ত্রী করা হয়। তথাকথিত দ্বিজদের মধ্য থেকে মুখ্যমন্ত্রীসহ মোট চারজন মন্ত্রী করা হয়। কোনো বর্ণের দুইজন মন্ত্রী ছিলেন না। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে কেশরী ১৯৭৩ সালে রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি হন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও চলতে থাকে তার রাজনীতি।
কর্পুরী ঠাকুর যখন ১৯৭৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী হন, তখন অ-দ্বিজ জাতিদের রাজনীতিতে উৎসাহ ছিল। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস এখন আরও দ্বৈতবাদী হয়ে উঠেছে। কংগ্রেস ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বিহার শাসন করেছে এবং এই সময়কালে পাঁচজন মুখ্যমন্ত্রী করেছে। কিন্তু মাত্র দুই উচ্চবর্ণের । চুপচাপ কংগ্রেসে থেকে গেলেন কেশরী। কংগ্রেসের রাজনীতি থমকে গিয়েছিল । তবে তিনি সেখানে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন। ১৯৯০ সালে মন্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হওয়ার পর তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কংগ্রেসেও কিছু পরিবর্তন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। নরসিমা রাওয়ের সরকার গঠিত হলে তাকে সামাজিক বিচার বিভাগের মন্ত্রী করা হয় তাকে । এরই মধ্যে তিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সম্ভাব্য কাজ করেছেন। উত্তর ভারতের রাজনীতিতে অনগ্রসর শ্রেণীর উত্থানে তিনি সক্রিয় ছিলেন। মুলায়ম, লালু ও নীতীশের জন্য তাঁর শুভকামনা ছিল।
এদিকে,১৯৯৬ সালে তাকে কংগ্রেস সভাপতি করা হয়। মনে হচ্ছিল কংগ্রেসে নতুন যুগ আসতে চলেছে। কিন্তু তা হয়নি। ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সালে দুই বছরের মধ্যে দুটি সরকার গঠিত এবং ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। দেবগৌড়ার পর এলেন গুজরাল। ডিএমকেও এই সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজীব গান্ধীর হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত এলটিটিই নেতাদের সাথে ডিএমকে-র যোগসাজশের প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং এর ভিত্তিতে কেসারি ডিএমকে মন্ত্রীকে অপসারণের দাবি করেছিলেন। গুজরাল পদত্যাগ করাই শ্রেয় মনে করেন।
ফলস্বরূপ,১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং কংগ্রেস ১৯৯৬ সালের তুলনায় মাত্র একটি আসন বেশি পায়। ঘটনাটি হল সোনিয়া গান্ধী এই নির্বাচনে প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কেশরী প্রায় গৃহবন্দী ছিলেন । কংগ্রেস নেতারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে কেশরী ইংরেজি জানেন না এবং দক্ষিণে কোনও প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবেন না। আইন অনুযায়ী, প্রত্যাশিত সাফল্য না পাওয়ার দায় সোনিয়া গান্ধীর ওপর চাপানো উচিত ছিল, কিন্তু দোষ চাপানো হয় সভাপতি কেশরির ওপর।
১৯৯৮ সালের ১৪ মার্চ,কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সভাপতিকে উপহাস করা হয়েছিল। প্রণব মুখোপাধ্যায় সোনিয়া গান্ধীকে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করার প্রস্তাব দেন এবং তা কোনো আলোচনা ছাড়াই হৈচৈ-এর মধ্যে পাস ঘোষণা করা হয়। উদ্দেশ্য শুধু নতুন সঙ্গে সভাপতি নির্বাচন করা ছিল না। কেশরীকেও অপমানিত হতে হয়েছে। এই তথাকথিত সভ্য দলের সভ্য লোকেরা তাদের ধুতি খুলে দিল। পুরো অফিস দখলের পর তাকে বাড়িতে যেতে দেওয়া হয়। কেশরীও চুমু খায়নি । অপমান পান করে চুপ করে রইলেন। ১৯৯৮ সালের ৯ মে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির আবার বৈঠক হয়। শারদ পাওয়ার, পিএ সাংমা এবং তারিক আনোয়ারকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করতে হয়েছিল কারণ এই লোকেরা সোনিয়াকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। আবারও একই কায়দায় অপমান করা হল কেশরীকে। তিনি অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন, হনুমানের মত তাঁর হৃদয় ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব ছিল না,তবে তিনি যতটা সম্ভব অনুনয় বিনয় করলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বিজ সংস্কৃতি এই পশ্চাদপদ নেতাকে তার হৃদয়ের বিষয়বস্তুতে বিব্রত করতে চেয়েছিল যাতে কেউ আর কখনও এমন আওয়াজ তুলতে না পারে।
কেশরী বিহারের বাসিন্দা এবং লালু প্রসাদের প্রতি কিছুটা আস্থা ছিল। লালু যখন পশুখাদ্য মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন তখন কেশরী তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাকে যখন জেলে যেতে হয়েছিল, তখন সম্ভবত কেশরীর পরামর্শ ছিল রাবড়িকে মুখ্যমন্ত্রী করা, অন্য কাউকে নয়। লালু তাকে চাচা বলে ডাকতেন। কিন্তু এই ঝামেলায় তিনি যখন রাজ্যসভার সদস্যপদ হারাতে শুরু করেন, তখন তিনি লালুর কাছ থেকে সহযোগিতা আশা করেন। লালু বুঝতেন সোনিয়া গান্ধীর মেজাজ । তিনি স্পষ্টভাবে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন।এই সব অপমান আর অবহেলার মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এই সমস্ত হৃদরোগে তিনি ২০০০ সালের ২৪ অক্টোবর দিল্লির এইমস-এ মারা যান।
নরেন্দ্র মোদি কেশরীর অপমানজনক ঘটনাকে তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতার বিষয়বস্তু করে তুলেছিলেন, প্রশ্ন করেছিলেন কংগ্রেসে পশ্চাদপদ শ্রেণীর নেতাদের কী অবস্থা ছিল কেশরির গল্প শুধু কংগ্রেসের নয়, আমাদের জাতীয় রাজনীতির চরিত্র ও মূল্যবোধকে সামনে নিয়ে আসে। কংগ্রেসের দিল্লি লবি কেশরীকে রাস্তার বিক্রেতা বলে ডাকত। তিনি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তারও দুর্বলতা ছিল । যেমন তিনি ইংরেজি জানতেন না। তবে বলা যায়, রাজনীতিতে তিনি বাড়ি লুট করেছেন, নির্মাণ করেননি। তার আর্থিক সততার জন্য তিনি কখনই সমালোচিত হননি বা তার পরিবারের কাউকে রাজনীতিতে উন্নীত করা হয়নি।
তার একমাত্র দোষ ছিল যে তিনি একটি অনগ্রসর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এবং এটাও সত্য যে তিনি কংগ্রেসকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর জন্য তিনি যে শাস্তি পেয়েছিলেন তা খুবই গুরুতর ছিল। সম্ভবত এই কারণেই কয়েক বছর আগে যখন অশোক গেহলটকে দলের সভাপতি হওয়ার জন্য জোর দেওয়া হয়েছিল, তিনি স্পষ্টতই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি হয়তো সীতারাম কেশরী হতে চান না।।