এইদিন ওয়েবডেস্ক,২১ নভেম্বর : বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের আগে ও পরে মুসলিমদের দ্বারা কি প্রকার নির্মম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছিল হিন্দুরা তা সকলের অজানা । সেই সময়ে বাংলাদেশের হিন্দু নরসংহারের ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ভারতে গোপন করে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে । যারা বাংলাদেশের মুসলিমদের অত্যাচারে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তাদের মুখেই অতীতে ইসলামি জিহাদিদের সেই বর্বরোচিত নৃশংস আচরণের কাহিনী অল্প বিস্তর শুনতে পাওয়া যায় । নিজের পরিবারের উপর ঘটে যাওয়া এমনই নৃশংস অত্যাচারের কাহিনি বর্ণনা করেছেন ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক বাংলাদেশি হিন্দু শরণার্থী ।
‘হিন্দু জাগরণ’-এর ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হওয়া ক্ষিতিশ সাধক নামে এই বাংলাদেশি হিন্দু শরনার্থীর বক্তব্য তুলে ধরা হল । প্রায় ৪০ বছর আগে নিজের পরিবারের উপর ঘটে যাওয়া সেই পাশবিক অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায় ওই বৃদ্ধকে ।
বৃদ্ধ বলেন,’সকাল ৭ টার সময় এক মৌলানা আমাদের বাড়িতে আসে । সে এসে বলে,অনন্ত তোমরা বাড়িতে থেকে না । তখন উত্তরে বলা হল ‘আমরা এতগুলো ভাই,বাড়িতে থাকব না কেন? ‘ মোল্লা বলল, ময়নাপাখি ধরার কল এসে গেছে । ময়নাপাখি কিন্তু ধরবে । তোমরা সরে যাও ।’
তিনি বলেন,’সাতটার সময় তিন দিকে রাস্তা দিয়ে গুলি চালাতে চালাতে আসতে শুরু করে মুসলিমরা । আমাদের গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলে । আমাদের বাড়িটা ছিল ৪২ বিঘা জায়গার উপর । কাকা জ্যাঠা সবাই ওই জায়গায় থাকতো । হামলা হওয়ার পর কেউ বাগানে লুকলো । কেউ পুকুরের পানায় গলা অব্দি জলে ডুবে থেকে আত্মরক্ষা করল । আমরা তখন ছোট । বয়স্কদের মারলেও ছোটদের মারেনি । মকবুল বলে আমার সহপাঠীকে ডাকলাম । রহমান, খালেক নামে আরও অনেকে আমার বন্ধু ছিল সেখানে । আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোরা বন্ধুলোক হয়ে আমাদের বাড়িতে হামলা করতে এসেছিস ? ওরা আমার বললো এদিকে আয়,তোর বউদির কি অবস্থা করেছে দ্যাখ ।’
বৃদ্ধ বলেন,’আমার সেই দাদা মর্ডান স্কুলের শিক্ষক ছিল । ওরা(হামলাকারীরা) বউদিকে ধরে পুকুর পাড়ে আনে । কয়েকজন গাছে নারকেল পাড়ছিল, জলে পড়ে যাওয়া নারকেল বউদিকে জল থেকে তুলে দিতে বলে । বউদি জলকে খুব ভয় করত । সেই বউদিকে ঘাড় ধরে জলে নামালো । আমারই সামনে, চুলের মুঠি ধরে । আমি তো কান্নাকাটি করছি । আমি বললাম, আমি জল থেকে নারকেল তুলে দিচ্ছি । এরপর একজন হামলাকারী গিয়ে বউদির স্তনদুটো কেটে দিল ।’
একথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই বৃদ্ধ । কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে তিনি ফের বলতে শুরু করেন,’তারপর বউদির ঘাড় ধরে পুকুরের জলে ঢুবিয়ে মেরে দিল ।’ বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বলেন,’আমি আর বলতে পারব না ।’ পরে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তিনি ফের বলতে শুরু করেন, ‘সেই অত্যাচার…. বংশের বাকিরা কোথায় যে গেল….কোথায় লুকালো….বাড়িঘর সব ফাঁকা….
কারোর খোঁজ নেই । আমি এই পর্যন্ত শেষ করব ।’
যদিও তিনি এখানেই শেষ করেননি । নিজের পরিবারের সদস্যদের গনহত্যার কাহিনী ফের তিনি বলতে থাকেন। বৃদ্ধ বলেন,’দাদাকে খালের ঘাটে নিয়ে গিয়ে ভোজালি দিয়ে কুপিয়ে মারল । আর একটা ভাইপোকে খালের পাড়ে হাতপা বেঁধে চিৎ করে ফেলে ছুরি দিয়ে গোটা শরীর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে দিল । দাদাকে মারার সময় মুসলিমরা বলছিল,’শালা,তোদের জ্বালায় আমরা বসবাস করতে পারছি না । যে জায়গাতেই যাই সেখানেই সাধক । ইস্কুলে যাই সাধক,থানায় যাই সাধক, রাস্তাঘাটে সাধক,তোদের জ্বালায় বসবাস করতে পারি না,দাঁড়া এইবার তোদের শেষ করব ।’
তিনি বলেন,’চোখের সামনে দাদা আর ভাইপোকে নৃশংসভাবে খুন হতে দেখে সেখানেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম । পরে হামলাকারীরা চলে গেলে আশপাশের দাদারা ছুটে এসে আমার জ্ঞান ফেরালো । আর বউদিকে পুকুরের জল থেকে তুলে পাড়ে মাটি দিয়ে দেহটা রাখা হল ।
বৃদ্ধ বলেন,’আমার তখন ২১ বছর বয়স পড়াশোনা মধ্যে ছিলাম । দেশের ভালোমন্দ খেয়াল করতাম না । আমাদের কাকা জ্যাঠা মিলে ১৪ টা পরিবার । সবারির চাকরি । কেউ মাস্টার, কেউ তহশিলদার, কেউ উকিল,কেউ দারোগা…. এইসব চাকরি করত । কিন্তু এই রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা আমরা কখনো ভাবিনি । যেহেতু আমাদের বংশের অনেক লোক, তাই ওসব নিয়ে আমরা বিশেষ ভাবতাম না ।
৩৫০ লোক, একই পরিবারে বসবাস করতাম । এজন্য স্থানীয় মুসলিমরা আমাদের ভয় করত ।’
তিনি বলেন,যখন মুজিবর রহমানের নির্বাচন হয়,বাংলাদেশ গঠিত হল চৈত্র মাসে, চৈত্র মাসে জয় বাংলা হয়ে গেল,বৈশাখ মাস থেকেই আমাদের উপর অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে । যেহেতু বংশ বড়, সকলেই শিক্ষিত,মুসলমানদের একটাই লক্ষ্য ছিল যে আগে সাধকদের মারো । সাধকদের না মারলে এই বারান্দা থানায় বসবাস করতে পারব না । এমন কথা সব সময় আমাদের কানে আসত । একারণে আমরা সব সময় লাঠিসোঁটা নিয়ে তৈরি থাকতাম।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের তিনি বলতে শুরু করেন, ‘কিন্তু দেখা গেল বৈশাখ মাসের শেষের দিকে একদিন পাড়ার ও ভিন পাড়ার মুসলমান, সব মিলে ৭-৮ টা পাড়ার মুসলমান এসে আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেললো । তারপর আমার সেজ দাদাকে মারল, একটা ভাইপো মারল,বউদিকে মারল, তার স্তন কেটে দিল,আমাদের সামনে তাড়া করে তাকে পুকুরে চুবিয়ে মারল ।’ ফের তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি ফের বলতে শুরু করেন, ‘ওই অবস্থায় আমরা বাড়ি ঘর ছেড়ে সবাই সুন্দরবনে চলে আসি । সুন্দরবনে ১৭ দিন থাকি । তারপরে ফকির আর রয়উদ্দিনরা নামে দুই পরিচিয় ব্যক্তি এসে বললো, ‘তোরা এখানে কি করিস? ওঠ আমাদের নৌকায় । মরতে তো হবেই । তোদের সাথে আমরাও মরব, চল ।’
তিনি আরও বলেন’ওরা আমাদের হাসনাবাদে আনল । ওখান থেকে বারাসত গেলাম । বারাসত থেকে আমরা চলে গেলাম গয়ায় । স্বাধীন হওয়ার পরে দেশে ফিরে গেলাম । কিন্তু আমাদের উপর টার্গেট থেকেই গেল মুসলমানদের ।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমরা দুই ভাই যাই । আমায় ওরা জমির ধান তোলার নাম করে ডেকে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক মারল । আমার ডান হাত ভেঙে গিয়েছিল । ওই অবস্থায় আমি নিজেই বাড়িতে আসলাম । আমি বাড়ির সকলকে বললাম,আমি আর এই দেশে থাকব না । তখন আমার দাদারা বললো, ১৪ টা ভাইয়ের মধ্যে তুই ছোট । তুই যদি চলে যাস তাহলে আমাদের আর আদরের পাত্র কে থাকলো? তোকে যেতে দেব না ।’ সব শেষে বৃদ্ধ বলেন,’কিন্তু আমি আর থাকিনি । আমি ভারতে চলে আসলাম । সরাসরি নৈনিতালে চলে যাই ।’
কিন্তু ওই বৃদ্ধের বাড়ি বাংলাদেশের কোন জায়গায় তা স্পষ্ট নয় । কত সালে ঘটনাটি ঘটেছিল তাও তার মুখ থেকে শোনা যায়নি । বৃদ্ধ আদপে কে এবং বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন তাও স্পষ্ট নয় ।
অবশ্য শান্তনু পাল নামে এক ব্যবহারকারী পোস্টের কমেন্ট সেকশনে লিখেছেন,’স্থান ময়মনসিংহ জেলার বাইলান(now name balian on gmap ) গ্রাম, সাল ১৯৬৭-৬৮ এর কথা, বাবা ১০ কাকা ৭ বছরের ছিল, তখন প্রায় পঁচিশ বিঘার মতো ভিটেমাটি ফেলে রাতারাতি পলায়ন করে এদেশে (ভারত) চলে আসে।বাবার ঠাকুরদা নাকি ওই গ্রামের কিরকম তশিলদার ছিল তাই তারই উপর প্রথম টারগেট ছিল।’।