জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গুসকরা(পূর্ব বর্ধমান),২০ এপ্রিল : কালবৈশাখী বা যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে চারপাশ কেমন যেন থমথমে হয়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগে হঠাৎ শুরু হয় প্রবল ঝড়। তৃণমূলের বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা সেই রকম- ব্লক কমিটি গঠন হলেও পদ হারিয়ে বা না পেয়ে সার্বিক বিষ্ফোরণ হলোনা। চুপচাপ। তবে কি এটা ঝড়ের পূর্বাভাস! এটুকু বলা যেতে পারে পঞ্চায়েত ভোটের পর কিছু একটা হবে।
ডানপন্থী দলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এখানে আবার পাড়ায় পাড়ায় নেতা। একজন নিজেকে অপরের থেকে বেশি জনপ্রিয় মনে করে। নিজের পরিবারের সদস্যদের ভোট পাবে কিনা সেই নিশ্চয়তা না থাকলেও পাঁচজনকে নিয়ে খুলে বসে দলীয় অফিস। তারপর পদের জন্য শুরু হয় কামড়াকামড়ি। শীর্ষ নেতৃত্বের পদলেহন। এতে জনমানসে দল সম্পর্কে ভুল বার্তা গেলেও বা দলের ক্ষতি হলেও এদের কিছু যায় আসেনা । অন্যের করুণ পরিণতি দেখেও এদের শিক্ষা হয় না।
সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় তৃণমূলের ব্লক কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও বিক্ষোভের খবর এলেও কোথাও আবার চুপচাপ। কেন তাকে পদ দেওয়া হলো এই প্রশ্ন তোলা না হলেও কেন তাকে বাদ দেওয়া হলো এই প্রশ্ন দু’একজন নাকি আলতো করে তুলেছে। লক্ষণ ভাল নয়।
২০১৯ সালের লোকসভা ও বিগত বিধানসভার ফলাফল পর্যালোচনা করলে রাজ্যের বিভিন্ন পঞ্চায়েতে বহু অঞ্চল সভাপতির বাদ যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা হতো। এদের সৌজন্যে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট কলঙ্কিত হয়েছিল। এদের একটা বড় অংশ সিপিএম থেকে আগত এবং এলাকায় ভাবমূর্তি ভাল নয়। অথচ ২০১১ ও ২০১৬ এর বিধানসভা ভোট, ২০১৪ এর লোকসভা ভোট এবং ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল সেইসব এলাকায় ভাল ফল করেছিল। যেভাবে অন্য দল থেকে এসে ‘ধান্দাবাজ’ তৃণমূল নেতাদের ম্যানেজ করে এরা দলীয় পদ পেয়েছে তেমনি বারবার ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও আজও তারা নিজেদের পদ বজায় রেখেছে। নিজ নিজ এলাকায় জনগণের কাছে এদের যা ইমেজ বা গ্রহণযোগ্যতা ফেয়ার ভোট হলে এদের হাত ধরে তৃণমূল কখনোই জয়ের মুখ দেখবেনা, সেটা প্রমাণিত।
অনেক ক্ষেত্রে জেলা সভাপতি বা ব্লক সভাপতির পরিবর্তন ঘটলেও, শীর্ষ নেতৃত্ব সব জেনেও, এদের পদের কোনো পরিবর্তন হলো না কেন? হতে পারে পঞ্চায়েত ভোট স্থানীয় স্তরের ভোট। ফলাফল অল্প ভোটের মার্জিনের উপর নির্ভরশীল। হয়তো এরা যাতে সাবাতোজ করতে না করতে পারে তাই আপাতত পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত তাদের রেখে দেওয়া হল । দলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানে এরা থাকলে দল হারবে। আবার না রাখলে সাবাতোজ করে দলকে হারিয়ে দেবে। পঞ্চায়েত ভোটের পর তাদের সরিয়ে দেওয়া অনেক সুবিধা হবে। তবে সবই সম্ভাবনা।
দলের দুর্দিনের কর্মীদের অনেকেই আশা করেছিল এবার হয়তো দল তাদের গুরুত্ব দেবে। আর দলের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবেনা। নতুন কমিটিতে স্থান না পেয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন । জনগণের কাছে এদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। সেটা বিগত বিধানসভা ভোটে প্রমাণিত। একের পর এক প্রথম শ্রেণির নেতারা দলত্যাগ করলেও তৃণমূলের ক্ষমতায় ফিরতে কোনো সমস্যা হয়নি। এখন এরা যদি নীরবে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে দেয় পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল বেশ কিছু জায়গায় চরম বেকায়দায় পড়ে যাবে। যতই তৃণমূল নেতৃত্ব অস্বীকার করুক, সেই ইঙ্গিত কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে।
পঞ্চায়েতে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরোধীদের বাধা দেওয়া যাবেনা,এই সিদ্ধান্তে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব যদি অটল থাকে তাহলে বেশ কয়েকটি বিধানসভা এলাকায় তৃণমূলের বিপর্যয় অনিবার্য। বিশেষ করে সেইসব জায়গায় যেখানে দলের দুর্দিনের কর্মীদের পরিবর্তে সিপিএম থেকে আগতরা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নীচু তলার সেইসব নেতা-কর্মীরা ২০১৮ সালের মত বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিরোধীরা রাষ্ট্রপতি শাসনের জোরালো দাবি তুলবে। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থা শাঁখের করাতের মত।
বিরোধী মঞ্চ কার্যত ফাঁকা হলেও দল নয় স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থী মানুষের কাছে তখন বেশি গুরুত্ব পাবে। তৃণমূলের একশ্রেণির নেতার যা উদ্ধত আচরণ তাতে থমথমে ভাব সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।।